জেনেভা ক্যাম্পে ৫ দিন ধরে মুহুর্মুহু গুলি-বিস্ফোরণ, পেছনে ‘শান্তিবাহিনী’

একের পর এক ককটেল বিস্ফোরণ। মুহুর্মুহু গুলির শব্দে আতঙ্কিত স্থানীয় বাসিন্দারা। রাজধানীর মোহাম্মদপুর জেনেভা ক্যাম্পে শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ীরা মাদকের স্পট দখলে নিতে গত কয়েকদিন ধরে ভয়াবহ সংঘর্ষে জড়িয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার (৭ আগস্ট) থেকে টানা পাঁচদিন ধরে থেমে থেমে চলছে ভয়াবহ এই সংঘর্ষ। মাদক ব্যবসায়ীদের আধিপত্যকে কেন্দ্র করে গত কয়েকদিনে অন্তত ৮টি ককটেল বিস্ফোরণের তথ্য জানিয়েছে ক্যাম্পের বাসিন্দারা। এমন ভয়াবহ সংঘর্ষের নেপথ্যে শান্তি বাহিনী নামক জেনেভা ক্যাম্পের একটি সন্ত্রাসী বাহিনী জড়িত বলে বাসিন্দারা অভিযোগ করেছেন।
স্থানীয়রা বলছেন, জেনেভা ক্যাম্পের শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ীদের অনেকেই আদালত থেকে জামিনে ছাড়া পাওয়ায় নতুন করে এই সংঘাতের সৃষ্টি হয়েছে। এমন অবস্থায় শীর্ষ এসব মাদক ব্যবসায়ীদের সব মামলায় জামিন বাতিল চেয়েছে বাসিন্দারা। অভিযোগ রয়েছে— থানাপুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ থাকায় শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ীরা সবসময় ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়।
এসব ঘটনায় এখন পর্যন্ত থানায় কোনো মামলা হয়নি বলে থানাপুলিশ সূত্রে জানা যায়। জানা যায়, গত বৃহস্পতিবার (৭ আগস্ট) রাত থেকে কয়েক দফায় শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী বুনিয়া সোহেল, পিচ্চি রাজা, মনু, ইশতিয়াক ও শান্তি বাহিনী মিলে একের পর এক স্থানীয় বাসিন্দাদের ওপর হামলা করে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। পরে যা সংঘর্ষে রূপ নেয়। গত পাঁচদিন ধরে চলা এ সংঘর্ষে এখন পর্যন্ত বেশ কয়েকজন বাসিন্দা আহত হয়েছেন। তবে তাদের কেউই মাদক ব্যবসায়ী ও শান্তি বাহিনীর বিরুদ্ধে মুখ খুলতে রাজি হননি। এদের মধ্যে গুরুতর আহতরা হলেন- বশির বাবুর্চি (৪০), মদিনা (২০) ও ফায়জান (২৫)।
জেনেভা ক্যাম্প বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে ও সূত্রে জানা যায়, ক্যাম্পের শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী বুনিয়া সোহেল ও বেজি নাদিম মিলে সন্ত্রাসী বাহিনী শান্তি বাহিনীকে ভাড়া করে। শান্তিবাহিনীর প্রধান শাহনেওয়াজ সান্নুর নেতৃত্বে পিচ্চি রাজার মাদকের স্পট দখলে নিতে প্রথমে ককটেল বিস্ফোরণ করে হামলা চালায়। এ সময় শান্তি বাহিনীর সঙ্গে বুনিয়া সোহেলকে পিস্তল উঁচিয়ে কয়েক রাউন্ড গুলি ছুঁড়তে দেখেছে বাসিন্দারা। পুরো জেনেভা ক্যাম্পের মাদক সাম্রাজ্য দখলে নিতে বুনিয়া সোহেলের সঙ্গে বেজি নাদিম, পোপলা মুন্না, চুয়া সেলিম, খুল্লা সাহিদ ও দোগলা আজম যোগ দিয়েছে। মাদক ব্যবসাকে কেন্দ্র করে এখন পর্যন্ত জেনেভা ক্যাম্পে বেশ কয়েকটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনাও ঘটেছে।
গত বৃহস্পতিবার (৭ আগস্ট) রাতে জেনেভা ক্যাম্পের পাকা ক্যাম্প এলাকায় শোহরাবের পান দোকানের সামনে বিয়ের হলুদ অনুষ্ঠান চলছিল। এ সময় বুনিয়া সোহেলের নেতৃত্বে কয়েকজন মাদক ব্যবসায়ী দেশীয় ধারালো অস্ত্র নিয়ে কয়েকটি ককটেল বোমা নিক্ষেপ করে।
এ সময় বাবুর্চি নাসির নামে একজন গুরুতর আহত হন। এ ঘটনার দুদিন পর ১০ আগস্ট দুপুর দেড়টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত জেনেভা ক্যাম্পের ৮ নম্বর সেক্টর এলাকায় তিন দফায় তিনটি ককটেল বোমা বিস্ফোরণ করে বুনিয়া সোহেল ও তার সহযোগীরা। এতে এলাকার অনেক দোকানের ক্ষয়ক্ষতি ও বেশ কয়েকজন আহত হন। এদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুতর আহত হয় মানসিক ভারসাম্যহীন নারী মদিনা বেগম।
এ ছাড়া, বুনিয়া সোহেল আগে থেকেই ৭ নম্বর সেক্টরের হুমায়ুন রোড এলাকায় হেরোইন বিক্রি করতো। সেখানে নতুন করে পিচ্চি রাজা ও মনু মিয়ার নেতৃত্বে ইমতিয়াজ হেরোইন ব্যবসা শুরু করে। পরে জামিনে মুক্ত হয়ে এ স্পট দখলে নিতে মরিয়া বুনিয়া সোহেল গ্রুপ।
জেনেভা ক্যাম্পের বাসিন্দা জিয়াউদ্দিন জানান, গত শুক্রবার (৮ আগস্ট) ও মাদক ব্যবসাকে কেন্দ্র করে বুনিয়া সোহেল পিচ্চি রাজাকে লক্ষ্য করে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায়। বুনিয়া সোহেল মোটরসাইকেলে করে এসে প্রকাশ্যে ককটেল ফাটিয়ে আবার চলে যায়। আজ (সোমবার) দুপুরেও শীর্ষ মাদক কারবারি বুনিয়া সোহেল জন্ডিস গলিতে এসে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায়। এতে এক নারী আহত হয়েছে শুনেছি।
তিনি আরও বলেন, পুলিশ বা অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জেনেভা ক্যাম্পে ঢোকার আগেই তারা খবর পেয়ে যায়। তারা বিভিন্ন জায়গায় সোর্স রাখে যাতে করে পুলিশ বা অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ঢুকলে তাদের কাছে দ্রুত খবর পৌঁছায়। আমাদের ধারণা পুলিশসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এদের সঙ্গে জড়িত রয়েছে। তা না হলে অভিযানের খবর তারা আগে থেকে কীভাবে জেনে যায়!
থানাপুলিশ সূত্রে জানা যায়, শীর্ষ মাদক কারবারি ও সন্ত্রাসী বুনিয়া সোহেলের নামে অন্তত ৩০টি মামলা রয়েছে। বুনিয়া সোহেল জেনেভা ক্যাম্পের ৭ নম্বর সেক্টরের আব্দুস সালামের ছেলে। বুনিয়া সোহেল ছাড়াও, পোপলা মুন্না, বেজি নাদিম, চুয়া সেলিম, খুল্লা সাহিদ ও দোগলা আজমের নামে একাধিক মাদক ও হত্যা মামলা রয়েছে। আরেক মাদক ব্যবসায়ী পিচ্চি রাজার নামে মাদক ও হত্যাসহ একাধিক মামলা রয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে জেনেভা ক্যাম্পের কয়েকজন বাসিন্দা জানান, গত বছরের ৩১ অক্টোবর সিলেটের কোতোয়ালি এলাকা থেকে বুনিয়া সোহেলকে র্যাব গ্রেপ্তার করে। এর কয়েক মাস পর জেল থেকে ছাড়া পেয়ে যায়। জেল থেকে বের হয়ে আবারও তার লোকজন দিয়ে মাদক ব্যবসা পরিচালনা শুরু করে। পরে চলতি বছরের ৪ জুন রাতে সেনাবাহিনী ও র্যাব-২ যৌথভাবে একটি ফার্মেসি থেকে বুনিয়া সোহেলের মাদক বিক্রির কয়েক কোটি টাকা জব্দ করে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের মোহাম্মদপুর জোনের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এসিডি) জুয়েল রানা জানান, মাদক ব্যবসায়ীরা আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছে। নিয়মিত তাদের গ্রেপ্তার করে আদালতে প্রেরণ করছি। এরপরও তারা জামিনে বের হয়ে ব্যবসা দখলে নিতে সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান অব্যাহত আছে। খুব শিগগিরই আবারও তাদের গ্রেপ্তার করব।
সংঘর্ষে নিহতের বিষয়ে জানতে চাইলে এডিসি জুয়েল বলেন, ধারালো অস্ত্রের আঘাতে শাহ আলম নামের একজন মারা গেছে। নিহত শাহ আলমের মরদেহ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে রাখা হয়েছে। এ ঘটনায় একজনকে দেশীয় অস্ত্রসহ আটক করা হয়েছে।