৩ বছর ঘুরে যুক্তরাষ্ট্রে, ৭ মাস বন্দি থাকার পর খালি হাতে দেশে

জমিজমা বিক্রি করে ২০২২ সালে দেশ ছাড়েন সিলেটের বাসিন্দা আলমগীর চৌধুরী। দালালের হাত ধরে প্রথমে যান তুরস্ক, সেখান থেকে গ্রিস, ইতালি। এরপর লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশ হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছান। এ পথে সময় লেগেছে প্রায় তিন বছর। যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে পা দিলেও স্বপ্ন পূরণ হয়নি তার। দীর্ঘ সাত মাস যুক্তরাষ্ট্রের একটি বন্দিশিবিরে থাকার পরে দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে তাকে।
অবৈধভাবে থাকার অভিযোগে গত ২ আগস্ট আলমগীর চৌধুরীসহ ৩৯ জন বাংলাদেশিকে একটি চার্টার্ড বিমানে ফেরত পাঠায় যুক্তরাষ্ট্র। যাদের প্রায় প্রত্যেকে বিভিন্ন সময়ে অবৈধভাবে সীমান্ত পেরিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে ঢোকেন এবং স্বেচ্ছায় সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেন।
আলমগীর চৌধুরী বলেন, ‘আমার আত্মীয় ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রে। তারা সহযোগিতা করেছেন। কিন্তু আদালত আমাদের থাকার অনুমতি দেননি। আমি দেশটিতে আশ্রয় চেয়েছিলাম, কিন্তু হয়নি। শেষ পর্যন্ত আমাদের দেশে ফেরত পাঠানো হয়। আমার অনেক বড় ক্ষতি হয়ে গেলো।’
আশ্রয় আবেদনের পুরো প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতে চাইলে আলমগীর বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে সীমান্তে প্রবেশের পর দেশটির অভিবাসন কর্তৃপক্ষ অবৈধ অভিবাসীদের আটক করে ডিটেনশন সেন্টারে নিয়ে যায়। সেখানে প্রথমেই তাদের ‘ক্রেডিবল ফিয়ার ইন্টারভিউ’ নেওয়া হয়। আবেদনকারীর দাবি যাচাই করা হয় যে, তিনি নিজ দেশে ফিরলে রাজনৈতিক, ধর্মীয়, জাতিগত নিপীড়ন বা প্রাণনাশের ঝুঁকিতে পড়বেন কি না। এই সাক্ষাৎকারে সন্তোষজনক উত্তর দিতে পারলে তাকে আশ্রয়প্রার্থী হিসেবে কোর্টে শুনানির সুযোগ দেওয়া হয়।
আলমগীর বলেন, এরপর শুরু হয় আদালত প্রক্রিয়া। যুক্তরাষ্ট্রের ‘ইমিগ্রেশন অ্যান্ড ন্যাশনালিটি অ্যাক্ট (INA)’ অনুযায়ী আইনগত প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়। একজন ইমিগ্রেশন জজ তার মামলার শুনানি করেন। আবেদনকারী ইচ্ছে করলে নিজের খরচে একজন আইনজীবী নিতে পারেন, তবে যুক্তরাষ্ট্র সরকার কোনো সরকারি আইনজীবী দেয় না। শুনানির পর বিচারক সিদ্ধান্ত নেন যে আবেদনকারী যুক্তরাষ্ট্রে থাকার উপযুক্ত কি না। যদি উপযুক্ত না হন তাহলে তাদের নিজ দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
আলমগীর চৌধুরী বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে যেতে আমার প্রায় ৩৫ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। আত্মীয়-স্বজনের মাধ্যমে টাকা-পয়সা ও আইনজীবীর ব্যবস্থা করি। এতে অনেক টাকা খরচ হয়েছে। শেষ পর্যন্ত আমাদের বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হলো।
তিনি বলেন, ‘শুরুতে যখন দেশ ছাড়ি তখন অনেক জায়গা-জমি বিক্রি করি। আমার স্বপ্ন ছিল যুক্তরাষ্ট্র যাব। ব্রাজিল থেকে মেক্সিকো হয়ে পানামার জঙ্গল পার হয়ে পৌঁছাতে লেগেছে ৮ মাস। অনেক কষ্ট করেছি। নদী, খাল, জঙ্গল—সব পার হয়েছি। কিন্তু এক টাকাও কামাতে পারিনি। এখন দেশে এসে আমি বেকার। অন্য কোনো দেশে যাওয়ার মতো অবস্থা নেই।’
আলমগীর চৌধুরী বলেন, ‘জেল থেকে আমাদের নিয়ে আসতে ৬০ ঘণ্টার মতো সময় লেগেছে। রাস্তায় শুধু ব্রেড আর সস খেতে দিত। ক্ষুধায় অনেক কষ্ট পেয়েছি। কিন্তু আমরা কোনো অপরাধ করিনি। অনেক দুর্বল হয়ে গেছি। বাড়ি যাওয়ার ভাড়া পর্যন্ত ছিল না। আমাদের এয়ারপোর্টে কাউকে দুই হাজার, কাউকে পাঁচ হাজার পর্যন্ত টাকা দেয়। দুই হাজার টাকা দিয়ে পরে বাড়িতে যাই।
‘হাতে রশি ও হাতকড়া পরিয়ে যাত্রার পুরোটা সময় এই অবস্থায় থাকতে হয়েছে। কোমরেও বেঁধেছে। দ্রুত যেন হাঁটতে না পারি, পায়েও রশি দিয়েছে।’ যোগ করেন আলমগীর চৌধুরী।
পুলিশের স্পেশাল ব্র্যাঞ্চ (এসবি) এবং ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন ডেস্ক জানিয়েছে, গত ফেব্রুয়ারি থেকেই ট্রাম্প প্রশাসন অবৈধ অভিবাসীদের যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া জোরদার করে। ট্রাম্পের এই কঠোর অভিবাসন নীতি গ্রহণের পর চলতি বছর ৩৯ জন বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠানো হয়।
গত ২ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্র থেকে একই ফ্লাইটে ফেরত এসেছিলেন নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী উপজেলার জায়েদ হাসানও। তিনিও একই অভিজ্ঞতার কথা জানান। যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার পেছনে তাকে খরচ করতে হয়েছে প্রায় ৪৫ লাখ টাকা। তিনি বন্দি ছিলেন প্রায় ছয় মাস, শেষ পর্যন্ত ফিরতে হয়েছে খালি হাতে।
তিনি বলেন, ‘গ্রামে অনেক ঋণ ও জমি বিক্রি করে গিয়েছিলাম। আমাদের সোনাইমুড়ী এলাকার বহু মানুষ এভাবে বাইরোডে যুক্তরাষ্ট্রে গেছে। ভাবছিলাম, বেকারত্ব ঘোচাতে একটা রিস্ক নিই। টাকা জোগাড় করতে লেগে যায় অনেক সময়। কিন্তু লাখ লাখ টাকা খরচ করে বুকভরা কষ্ট নিয়ে ফিরছি।’
জায়েদ হাসানের বাবা সাজ্জাদ হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘দালাল ঘুরিয়েছে প্রায় দুই বছর। চুক্তি ছিল ছেলে যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছাবে, কিন্তু সে কিছু টাকা আটকে রেখে ঘুরিয়েছে। নাহলে আরও আগেই পৌঁছাতে পারতো। ছেলের কসমেটিকের দোকান ছিল। সবকিছু বিক্রি করে ছেলে এখন বেকার।’
জানা গেছে, বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর বিপুল সংখ্যক তরুণ দালালের খপ্পরে পড়ে অবৈধভাবে লাতিন আমেরিকার ঝুঁকিপূর্ণ রুটে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশে রওয়ানা দেন। অনেকেই পৌঁছাতে সক্ষম হন। এদের মধ্যে অধিকাংশ আশ্রয়প্রার্থীর আবেদন যুক্তরাষ্ট্রের আদালত প্রত্যাখ্যান করে।
জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনারের (ইউএনএইচসিআর) তথ্য বলছে, পাঁচ বছর ধরে বাংলাদেশি শরণার্থীর সংখ্যা ক্রমাগত বেড়েছে। ২০২৪ সালে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আশ্রয় চেয়েছেন এক লাখ আট হাজার ১৩১ জন বাংলাদেশি। এর আগের বছর ২০২৩ সালে এই সংখ্যা ছিল ৭৫ হাজার ৮৬৭ জন। ২০২২ সালে ছিল ৬১ হাজার ২৯৮, ২০২১ সালে ৬৫ হাজার ৪৯৫ এবং ২০২০ সালে ৬৪ হাজার ৬৩৬ জন।
২০২৪ সালে প্রায় আট মাসের চেষ্টায় ৪৫ লাখ টাকা খরচ করে মেক্সিকো হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছান নোয়াখালীর চাটখিলের বাসিন্দা আমজাদ হোসেন (ছদ্মনাম)। আশ্রয় প্রার্থনা করলে যুক্তরাষ্ট্রের আদালত তাকে থাকার অনুমতি দেয়। সেখান থেকে বের হয়ে তিনি নিউইয়র্কে মামার বাসায় ওঠেন।
তিনি জাগো নিউজকে বলেন, এখানে আসার পর মোটামুটি ভালোই কাজ করেছি। কিন্তু এখনো আমি গ্রিনকার্ড পাইনি। টেনশনে আছি। ঠিকমতো বাইরেও বের হতে পারছি না। কাজে যেতেও ভয় লাগে। যদি গ্রেফতার করে দেশে পাঠিয়ে দেয়।
তিনি বলেন, এখানে এসে ভালো করে কাজ করলে এক থেকে দেড় বছরের মধ্যেই আসার খরচ পরিশোধ করা যায়। এজন্যই মানুষ লাখ লাখ টাকা ঋণ করে এখানে আসে।
অভিবাসন বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রে অনুপ্রবেশের হার বাড়ছে দক্ষিণ এশিয়া, বিশেষ করে বাংলাদেশের তরুণদের মধ্যে। তবে এসব যাত্রা কেবল অর্থনৈতিক ক্ষতি নয়, জীবন ঝুঁকিরও কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। অনেক দালাল অবৈধ পথে নিয়ে রিফিউজি হওয়ার লোভ দেখায়। জেনে বুঝে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি দিতে হবে। দালালের প্রলোভনে একবার ভুল করলে অনেক বিপদে পড়তে হতে পারে।