ঐকমত্যে পাথর লুটে প্রশাসন পাহারাদার
স্বচ্ছ নীলাভ জল, তলদেশজুড়ে ছড়িয়ে থাকা সাদা-ধূসর পাথর আর চারপাশের সবুজ পাহাড় মিলে সিলেটের কোম্পানীগঞ্জের সাদাপাথর পর্যটন কেন্দ্র দীর্ঘদিন ধরে ভ্রমণপিপাসুদের কাছে স্বর্গরাজ্য হিসেবে পরিচিত। কিন্তু সম্প্রতি সব রাজনৈতিক দলের স্থানীয় নেতাদের যোগসাজশে ভয়াবহ পাথর লুটে সে সৌন্দর্য প্রায় বিলীন হয়ে গেছে।
গত আগস্টে সংগঠিত সংঘবদ্ধ লুটপাটে কোম্পানীগঞ্জের ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারি, শাহ আরেফিন টিলা, জাফলং, বিছনাকান্দি ও উৎমাছড়াসহ সিলেটের প্রধান পর্যটনকেন্দ্রগুলো থেকে কোটি কোটি টাকার পাথর সরিয়ে নেওয়া হয়। স্থানীয়রা অভিযোগ করেন, প্রশাসন, বিজিবি ও পুলিশ সবকিছু জেনেও নীরব দর্শকের ভূমিকায় ছিল। ভাগবাটোয়ারার অংশ গিয়েছিল জেলা প্রশাসন ও উপজেলা কার্যালয়েও।
পরিবেশকর্মীদের হিসাব অনুযায়ী, গত এক বছরে প্রায় ৪ কোটি ঘনফুট পাথর লুট হয়েছে। এর বাজারমূল্য কয়েক হাজার কোটি টাকা। অথচ বিশেষ অভিযানে উদ্ধার হয়েছে মাত্র সাড়ে ৪ লাখ ঘনফুট পাথর। স্থানীয়রা বলছেন, প্রশাসনের বর্তমান অভিযান আসলে ‘আইওয়াশ’।
রাষ্ট্রক্ষমতার পরিবর্তনের পর আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন, এনসিপি ও গণঅধিকার পরিষদ—সব দলের স্থানীয় নেতারা প্রকাশ্যে কোয়ারি চালুর দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন। মানববন্ধন ও বিক্ষোভে নেতারা একসুরে বলেন, “পাথর উত্তোলন বন্ধ রেখে মানুষের জীবিকা ধ্বংস করা হয়েছে।” ফলে আইনের শাসন কার্যত অকার্যকর হয়ে পড়ে।
জামায়াতের জেলা সেক্রেটারি জয়নাল আবেদীন এক সমাবেশে হুমকি দিয়ে বলেন, “কোয়ারি না খুললে কোনো নির্বাচন হবে না।” ইসলামী আন্দোলনের নেতারা সরাসরি ঘোষণা দেন, “প্রয়োজনে মব সৃষ্টি করে হলেও পাথর উত্তোলন করা হবে।” বিএনপি ও আওয়ামী লীগের অনেক শীর্ষ নেতাকর্মীর নামও লুটের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে এসেছে।
লুটের সময় বিজিবি ক্যাম্পের সামনেই নৌকায় পাথর তোলা হয়েছে। শ্রমিকরা জানান, গর্তপ্রতি বিজিবি সদস্যদের টাকা দিতে হয়। এরপর পুলিশ ও প্রশাসনের মাসোহারা দিতে হয়। রাজনৈতিক নেতাদের গাড়িপ্রতি ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকা দিতে হতো।
কোম্পানীগঞ্জ থানায় অন্তত ১৯টি মামলা হলেও অধিকাংশেই নাম এসেছে শ্রমিকদের। প্রভাবশালী হোতারা থেকে গেছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। গোয়াইনঘাটে ১১টি মামলা হলেও অভিযুক্ত ২৫১ জনের অধিকাংশই এখনও গ্রেপ্তার হয়নি। পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, “রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক মদদেই চতুর্মুখী লুটপাট হয়েছে।”
জাফলং, বিছনাকান্দি, উৎমাছড়া ও সাদাপাথরের দৃশ্যপট এখন প্রায় শূন্য। একসময় পাহাড়-নদীর পটভূমিতে পর্যটকদের টানত যে সাদা পাথর, তা এখন বালুচরে পরিণত। শাহ আরেফিন টিলার সুউচ্চ টিলা ভেঙে হয়েছে গহ্বর। স্থানীয় চা বিক্রেতা মোশারফ আলী বললেন, “যে বাঙ্কার ভর্তি পাথর ছিল, সব লুট হয়ে গেছে।”
১২ আগস্ট একটি জাতীয় দৈনিকের ভিডিও প্রকাশের পর নড়েচড়ে বসে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সাদাপাথরে গিয়ে তারা পাথর লুটের প্রমাণ পায় এবং সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দেয়। জেলা প্রশাসকও অভিযান শুরুর কথা জানান। তবে পরিবেশবাদীরা বলছেন, “এখন যা বাকি আছে তা রক্ষার চেয়ে অনেকটাই দেরি হয়ে গেছে।”
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) বারবার প্রশাসনকে সতর্ক করলেও পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। বেলার আঞ্চলিক সমন্বয়ক শাহ শাহেদা আখতার বলেন, “রাজনৈতিক নেতা থেকে প্রশাসন—সবাই মিলে এ লুটপাট হয়েছে। কার্যকর ভূমিকা ছিল না কারও।”
পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান জানিয়েছেন, স্থানীয় প্রশাসন নীরব কিংবা যোগসাজশে জড়িত ছিল। তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি বলেন, “যারা পাথর লুটপাট করে প্রকৃতির স্বর্গ ধ্বংস করেছে, তাদের আইনের আওতায় আনতেই হবে।”





































