সেনাবাহিনীর ৩ আগস্টের সিদ্ধান্ত শেখ হাসিনার পতন অনিবার্য করে তোলে

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের পতনের বর্ষপূর্তি আজ। গত বছর এই দিনে সেনাবাহিনী প্রধান, সেনাবাহিনী এবং সার্বিকভাবে সশস্ত্র বাহিনীর জনগণের পক্ষে অবস্থান নিয়ে প্রশংসনীয় ভূমিকার বিষয়টি সচেতন মহল স্মরণ করছে। তাঁদের মূল্যায়ন, সেনাবাহিনী প্রধান নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনী প্রধানদের এবং তাঁর সহযোগী অন্যান্য সামরিক কর্মকর্তার সঙ্গে সম্মিলিতভাবে দেশের ক্রান্তিকালে সাহসী ও সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিয়ে যেভাবে সেদিন দেশ ও জনসাধারণের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন, জন-আকাঙ্ক্ষার প্রতি সম্মান জানিয়েছেন, তা ইতিহাসে অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
গত বছরের ৫ আগস্ট দুপুর দেড়টার দিকে আইএসপিআর থেকে বার্তা আসে, দুপুর ২টায় সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামান জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন।
সবার চোখ টিভির দিকে। ২টা পেরিয়ে যায়। আইএসপিআর আবার জানায়, সেনাপ্রধান বিকেল ৩টায় ভাষণ দেবেন। আগের দিনও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ঘিরে সহিংসতায় শতাধিক প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে।
কারফিউ উপেক্ষা করে শেখ হাসিনা সরকারের পদত্যাগ দাবিতে ‘লং মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিতে উত্তাল দেশ। সকাল ১১টার পর থেকে শাহবাগ, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারসহ রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট লোকারণ্য। ছাত্র-জনতার গন্তব্য কড়া নিরাপত্তাবেষ্টিত গণভবন। উৎকণ্ঠা ও আশঙ্কার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে স্বস্তির খবর।
বিকেল ৪টার দিকে সেনাপ্রধান জানালেন, প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে দেশ ছেড়েছেন শেখ হাসিনা। বললেন, ‘আমাদের সহযোগিতা করেন। কথা দিচ্ছি, প্রতিটি হত্যার বিচার হবে। আশাহত হবেন না। আমরা দায়দায়িত্ব নিচ্ছি।
সেনাবাহিনী, সশস্ত্র বাহিনীর প্রতি আস্থা রাখুন। সব দাবি পূরণ হবে। দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরে আসবে। আমরা মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে যাব। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের বিষয়ে উনার সঙ্গে কথা বলব। তাঁর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করে দেশ পরিচালনা করা হবে।’
এর দুই দিন আগেই ৩ আগস্ট এই বার্তা ছড়িয়ে পড়ে যে, সেনাবাহিনী ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালাবে না। ৪ আগস্ট রাওয়া ক্লাবে সাবেক সেনা কর্মকর্তারা আন্দোলনের পক্ষে অবস্থান নেওয়ার ঘোষণা দেন। মিরপুর ও মহাখালী ডিওএইচএসে সেখানকার নিয়ম লঙ্ঘন করে সাবেক সেনা কর্মকর্তাদের সন্তানরা সরকার পতনের দাবিতে মিছিল করে। সামরিক বিশেষজ্ঞদের মতে, এইসব ঘটনা আন্দোলনের তীব্রতা বাড়ায়। বিশেষ করে সেনাবাহিনীর ৩ আগস্টের সিদ্ধান্ত শেখ হাসিনার পতন অনিবার্য করে তোলে। মেজর জেনারেল (অব.) কাজী ইফতেখার-উল-আলম, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. জাহেদুর রহমানসহ অনেক সামরিক বিশেষজ্ঞ এমনটাই মনে করেন।
মেজর জেনারেল (অব.) কাজী ইফতেখার-উল-আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের চূড়ান্ত পরিণতি আসে গত বছরের ৫ আগস্টে। তার আগে ৩ আগস্ট সেনাপ্রধানের নেতৃত্বে সেনা কর্মকর্তাদের একটা দরবার হয়। সেই দরবার থেকে যে সিদ্ধান্ত আসে, তা ৫ আগস্টের পরিণতিকে প্রভাবিত করে। তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, হুট করেই ৩ আগস্টের সেই সিদ্ধান্ত আসেনি। আগে থেকেই সরকারের আনপপুলার কিছু কিছু সিদ্ধান্ত, ভুল, সেনাবাহিনীর অনেক সদস্য পছন্দ করছিলেন না। বিভিন্ন ধরনের বিতর্কিত বিষয় রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছিল। দেশের টাকা পাচার হয়ে যাওয়া, গুম, খুন—এগুলো আলোচিত হচ্ছিল। পুলিশ কর্তৃক বিভিন্ন জায়গায় হেনস্তা, নাগরিক সেবা ব্যাহত হওয়া সেনা সদস্যদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে সেনাপ্রধান ৩ আগস্ট যখন দরবার নিলেন, উনি সেনা সদস্যদের, বিশেষ করে জুনিয়র অফিসারদের পালস বুঝতে চাইলেন।’
তিনি বলেন, “বাংলাদেশ সেনাবাহিনী একটি সুশৃঙ্খল বাহিনী। এর কমান্ড স্ট্রাকচার যথেষ্ট ভালো এবং শক্তিশালী। দেশের কোনো একটি বিষয়ে হঠাৎ বলা হলো ‘মানি না’, তা হতে পারে না। ৩ আগস্টে সেনা সদস্যদের দীর্ঘ সময়ের পুঞ্জীভূত অসন্তুষ্টির এবং দেশ ও দেশের জনগণের পক্ষে থাকার ইচ্ছার প্রকাশ ঘটে। দেশপ্রেম ও জনস্বার্থ এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এর বড় একটি উদাহরণ ১৯৯০ সালে এরশাদের প্রতি সেনাবাহিনীর সমর্থন প্রত্যাহার।”
জেনারেল এরশাদ সেনা সদস্যদের কাছে জনপ্রিয় ছিলেন। তার পরও তাঁর বিরুদ্ধে ব্যাপক গণ-আন্দোলন শুরু হলে জনগণের বিপক্ষে সেনাবাহিনী তাঁকে আর সমর্থন দেয়নি। ১৯৭১ সালে বাঙালি সেনারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অধীনে ছিল। তারা নিজ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়। সেনাবাহিনীতে বিদ্রোহের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। এই মৃত্যুদণ্ড ফায়ারিং স্কোয়াডে কার্যকর করা হয়। তার পরও এই শাস্তির বিষয় জেনে-বুঝে বাঙালি সেনারা মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য বিদ্রোহ করে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। একইভাবে দেশের স্বার্থে ৩ আগস্ট সেনাবাহিনী দেশের জনগণের পক্ষে অবস্থান নেয়। পরদিন ৪ আগস্ট অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তাদের সংগঠন রাওয়া সাধারণ ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সংহতি প্রকাশ করে। ডিওএইচএসগুলোতে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, মিছিলে নিষেধাজ্ঞা থাকার পরও মিরপুর ও মহাখালী ডিওএইচএসে সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মিছিল হয়। সাবেক সেনা কর্মকর্তারা, তাঁদের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলে-মেয়ে ও পরিবারের অন্য সদস্যরা মিছিলে অংশ নেন। বিইউপিতে একটি বিশেষ বাহিনী ও পুলিশ হামলা চালানোর পর এই প্রতিবাদ মিছিল হয়। এসব ঘটনা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে সর্বজনীন করে তোলে।’
ইফতেখার-উল-আলম বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ৬২৬ জন সেনানিবাসে আশ্রয় নিয়েছিলেন। আমি মনে করি, এ ক্ষেত্রে সেনাবাহিনী মানবিকতার পরিচয় দিয়েছে। বিচারবহির্ভূত হত্যা কোনো সভ্য সমাজ মেনে নিতে পারে না। আশ্রয়প্রার্থীরা সেনানিবাসগুলোতে প্রবেশ করেন প্রাণ বাঁচানোর জন্য। তাঁদের যাতায়াতে সেনানিবাসে কোনো বাধা-নিষেধ ছিল না। তাঁদের মধ্যে প্রায় ৫১৫ জন ছিলেন পুলিশ সদস্য। বিচারক এবং কয়েকজন রাজনীতিবিদ সরকারি প্রোটোকল নিয়ে নিজেদের গাড়িতে নিজ উদ্যোগে বিভিন্ন সেনানিবাসে প্রবেশ করেন। তাঁদের বিরুদ্ধে তখনো কোনো মামলা হয়নি। এমন ঘটনা ঘটেনি যে, সেনাবাহিনীর গাড়িতে করে সেনানিবাসে তাঁদের নিয়ে আসা হয়। পরে অভিযুক্ত কয়েকজনকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া হয়। আইএসপিআর এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্যও প্রকাশ করে। বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টির অপচেষ্টা হয়েছে। সম্প্রতি গোপালগঞ্জে যে ঘটনাটি ঘটেছে, তাতে সেনাবাহিনী ব্যবস্থা না নিলে নতুন একটি রাজনৈতিক দলের নেতাদের প্রাণহানিও ঘটতে পারত। অভ্যুত্থানের সময় আহত জুলাই যোদ্ধাদের চিকিৎসায়ও সেনাবাহিনীর উদ্যোগ প্রশংসার দাবি রাখে। প্রায় চার হাজার ৭৯০ জনকে দেশের বিভিন্ন সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়েছে।’
সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা আরো বলেন, ‘৫ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের সার্থকতা পাব না, যদি না আমরা অতীতের ভুলগুলো সংশোধন করতে পারি; নিজেদের মধ্যে হানাহানি, দ্বন্দ্ব ভুলে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে না পারি। জাতি হিসেবে বিশ্বে সম্মানজনক পরিচিতি নিশ্চিত করতে না পারি।’
বাংলাদেশের ইতিহাসে ২০২৪ সালের জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থান একটি গতিপথ পরিবর্তনের মতো ঘটনা বলে মনে করেন সামরিক বিশেষজ্ঞ এবং ফাউন্ডেশন ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. জাহেদুর রহমান। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বাংলাদেশ সেনাবাহিনী জুলাইয়ের সূচনালগ্ন থেকে পরিস্থিতির ওপর তীক্ষ দৃষ্টি রাখে এবং ঘটনাবলি সম্পর্কে সম্যক অবহিত থাকে। আন্দোলনের শুরুতে সেনাবাহিনী মূলত আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীকে সহায়তা করার দায়িত্বে নিয়োজিত হয়। সেনাবাহিনী গণসমাবেশ নিয়ন্ত্রণ এবং গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাসমূহ রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় সৈন্য মোতায়েন করে। মধ্য জুলাই থেকে এই অবস্থানের পরিবর্তন হতে থাকে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীগুলোর, যেমন—পুলিশ, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ ইত্যাদির এবং স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগের সংগঠন ছাত্রলীগের প্রয়োজনাতিরিক্ত বল প্রয়োগ, মারণাস্ত্র ব্যবহার ও ক্রমবর্ধমান সহিংসতার আলোকে সেনাবাহিনী তার অবস্থান ও ভূমিকা পুনর্বিবেচনা করতে বাধ্য হয়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দেশের সব দুঃসময়ে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘জুলাই মাসের তৃতীয় সপ্তাহের শেষের দিক থেকেই সাধারণ ছাত্র-জনতার ওপর আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীগুলোর অমানবিক অত্যাচার, নিরস্ত্র জনগণের ওপর গুলি চালিয়ে নির্বিচারে হত্যাকাণ্ড সেনাবাহিনীর সর্বস্তরের সদস্যকে ভাবিয়ে তোলে। যে বাহিনী দেশের অখণ্ডতা রক্ষা করার জন্য এবং দেশের জনগণের জীবন রক্ষা করার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, তার পক্ষে এই অন্যায় মেনে নেওয়া সম্ভব হয় না। তাদের এই অবস্থানের বার্তাটি সরকারপ্রধানের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়। এই অবস্থানটি গণ-অভ্যুত্থানকে গতিশীল করে এবং সরকারের পতন ত্বরান্বিত করে। এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা কঠিন পেশাগত চ্যালেঞ্জ ছিল। তবে নৈতিকতা, মানবিকতা ও দেশপ্রেম সবার ঊর্ধ্বে। এই বোধের জায়গা থেকে সেনাবাহিনী সঠিক ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। অভ্যুত্থানের পর সেনাবাহিনী রাষ্ট্রের সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষায় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি অনুগত থেকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করা এবং কৌশলগত অবকাঠামোগুলো রক্ষা করার দায়িত্ব পালন করেছে।’
জাহেদুর রহমান আরো বলেন, ‘নির্মোহ বিশ্লেষণে দেখা যায়, সেনাবাহিনীর কোনো রাজনৈতিক অভিলাষ ছিল না, ছিল না ক্ষমতা দখলের অভিপ্রায়। তারা দেশের প্রয়োজনে, মানুষের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা থেকে দেশের জন্য মঙ্গলজনক দায়িত্বটি পালন করেছে। ফলে বাংলাদেশের মানুষ একটি নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেথছে, যে বাংলাদেশের মূল বৈশিষ্ট্য হবে অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতন্ত্র, অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্র, কল্যাণমুখী, বাক ও ব্যক্তি স্বাধীনতায় বিশ্বাসী এবং অবশ্যই দুর্নীতিমুক্ত। অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতন্ত্র নিশ্চিত করার জন্য সব ধর্ম, জাতি, লিঙ্গ ও বর্ণের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। সবার আগে বাংলাদেশ—এই বোধটি সবার মাঝে সঞ্চারিত হলে কোনো দূরত্বই দূরত্ব নয়, কোনো পথ অনতিক্রম্য নয় এবং কোনো স্বপ্নই অধরা নয়।’
লেখক : নগর সম্পাদক, কালের কণ্ঠ