বৃহস্পতিবার , ০৭ আগস্ট ২০২৫
Thursday , 07 August 2025
১১ সফর ১৪৪৭

ইকরামউজ্জমান

প্রকাশিত: ১৩:৫৫, ৬ আগস্ট ২০২৫

নারী ফুটবলাররা দেশকে গৌরবান্বিত করছেন

নারী ফুটবলাররা দেশকে গৌরবান্বিত করছেন
ছবি: সংগৃহীত

নারী ফুটবলের সাফল্য এখন দেশের ক্রীড়ামোদী সমাজে বিশেষ আলোচনার বিষয়। এটি নারী ফুটবলার, তাদের সংশ্লিষ্ট মহল, বিশেষ করে ‘নারী ফুটবল উইং’ এবং বাফুফের বিশাল অর্জন। নারী ফুটবল এরই মধ্যে দেশের ফুটবল ইতিহাসে বড় স্থান অধিকার করে নিয়েছে। নারী ফুটবল নিয়ে ‘ডেসক্রিপটিভ’ নিবন্ধ রচনা যত সহজ, মাঠে নারী খেলোয়াড়দের উত্থান, খেলার জন্য তাদের আত্মত্যাগ, সংগ্রাম এবং ‘ডেস্টিনেশনে’ পৌঁছানোর জন্য তাদের ইতিবাচক সাহসী মানসিকতা, ইচ্ছাশক্তির সঙ্গে অভিলাষী মন নিয়ে লেখা পরম আনন্দজনক হলেও বিষয়টি কিন্তু এত সহজ নয়।

গবেষণা কার্যক্রমে নারী ফুটবল এখন অনেক বেশি এগিয়ে আর এই মনোযোগ তাদের প্রাপ্য। নারীরা দেশের ফুটবলের প্রেক্ষাপট পাল্টে দিয়েছেন।

নারী ফুটবলাররা দেশকে গৌরবান্বিত করছেনবৈষম্যে ভরা ফুটবল অঙ্গনে নারী ফুটবলাররা চিন্তা-ভাবনায় পরিবর্তন সাধনের পাশাপাশি দেশবাসীর আশা ও আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হিসেবে ‘সিঙ্গেল আউট’ হয়েছেন। যে ধরনের পরিপক্বতার স্বাক্ষর রেখেছেন—এটি সত্যি অসাধারণ।

পুরুষ খেলোয়াড়দের ভীষণভাবে পেছনে ফেলে নারীরা এগিয়ে চলেছেন। নারীরা যে স্বপ্নের কথা প্রকাশ্যে সহজভাবে বলতে পারছেন, পুরুষরা সেটি পারছেন না। নারী ফুটবলারদের প্রতি মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস ক্রমেই বেড়ে চলেছে। তাঁরা ভাবছেন, নারী ফুটবলারদের পক্ষে অনেক কিছুই সম্ভব।
এতে কিন্তু চাপ বাড়ছে। তবে নারীরা কিন্তু এই বিষয়টিকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে চাপ হিসেবে না দেখছেন নতুন সুযোগ হিসেবে। নতুন ইতিহাস সৃষ্টির হাতছানি হিসেবে। এখানেই নারী ফুটবলাররা অনন্য।
অনূর্ধ্ব-২০ এশিয়ান কাপ বাছাইপর্বে বাংলাদেশ ‘এইচ গ্রুপে’ লড়বে লাওস, পূর্বতিমুর এবং দক্ষিণ কোরিয়ার বিপক্ষে।

দক্ষিণ কোরিয়ার ফুটবল শক্তি সম্পর্কে সচেতন মহল অবগত। আজ ৬ আগস্ট বাংলাদেশ প্রথম ম্যাচ খেলবে স্বাগতিক লাওসের বিপক্ষে। বাংলাদেশ নারী দলের জন্য আজকের ম্যাচটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। দল হিসেবে সাহসের সঙ্গে গেম পরিকল্পনাকে বাস্তবে বাস্তবায়িত করতে পারলে লাওসের বিপক্ষে জয় নিয়ে মাঠ থেকে ফিরে আসা সম্ভব। জয় দিয়ে শুরু সব সময় আত্মবিশ্বাস বাড়ায়। এ ছাড়া কোচ কিন্তু এই কম্পিটিশনকে আগামী বছর মার্চে অস্ট্রেলিয়াতে অনুষ্ঠিত এশিয়ান কাপের চূড়ান্ত পর্বে অংশগ্রহণের প্রস্তুতির কাজে লাগাবেন। দলে বেশ কয়েকজন খেলোয়াড় আছেন, যাঁরা জাতীয় দলের হয়ে দেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। পাশাপাশি অনূর্ধ্ব-২০ স্কোয়াডের সদস্যদের পরখ করার সুযোগ পাবেন কোচ দক্ষিণ এশিয়ার বাইরে আন্তর্জাতিক চত্বরে।
বাংলাদেশ ৮ আগস্ট খেলবে পূর্ব তিমুর আর ১০ আগস্ট দক্ষিণ কোরিয়ার বিপক্ষে। ৩২ দলের বাছাই পর্বে আট গ্রুপের সেরা আট দল সরাসরি যাবে এশিয়ান কাপে। এ ছাড়া গ্রুপের দ্বিতীয় সেরা তিনটি দলও পাবে জায়গা। যেহেতু গ্রুপে দক্ষিণ কোরিয়া আছে—আর তাই গ্রুপের দ্বিতীয় সেরা হিসেবে বাংলাদেশ দল চাইছে এশিয়ান কাপের চূড়ান্ত রাউন্ডে যেতে। আগামী বছর এপ্রিল মাসে থাইল্যান্ডে চূড়ান্ত খেলা অনুষ্ঠিত হবে।

কিছুদিন আগে মায়ানমারে বাংলাদেশ জাতীয় নারী দল এবারই প্রথম এশিয়ান নারী চ্যাম্পিয়নশিপে বারো দলের মধ্যে স্থান করে নিয়েছে। র্যাংকিংয়ে এগিয়ে থাকা দলের বিপক্ষে সাহসের সঙ্গে লড়ায় সাধারণ মহলে আত্মবিশ্বাসের জন্ম হয়েছে—অবশ্যই লাওসে অনূর্ধ্ব-২০ নারী ফুটবলে কোয়ালিফাই করা সম্ভব। সাধারণ মহলের প্রত্যাশা অস্বাভাবিক কিছু নয়। মানুষ তো চাইবে দেশকে খেলার মাঠে ভালো অবস্থায় দেখতে।

অভিজ্ঞ ব্রিটিশ কোচ পিটার বাটলার নারী দলের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে দলের চিন্তা-ভাবনা, মাঠে কৌশল, আত্মবিশ্বাস, সাহস, শৃঙ্খলা, নিয়ম-নীতি, প্রতিভার সর্বোচ্চ ব্যবহার পারফরম্যান্সই শেষ কথা, খেলোয়াড়দের মধ্যে স্বতঃস্ফূর্ততা এবং তাদের মানসিকতায় এসেছে আমূল পরিবর্তন। যদিও কোচকে তার চিন্তা-ভাবনা বাস্তবায়িত করতে গিয়ে প্রথম দিকে কিছু সিনিয়র খেলোয়াড় এবং কর্মকর্তাদের তরফ থেকে বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হয়েছে। পিটার কিন্তু তাঁর নীতি ও আদর্শের প্রশ্নে আপস করেননি। তিনি সব সময় বলেছেন, আমি নারী ফুটবলের ভালো চাই। আমার ব্যক্তিগত কোনো এজেন্ডা নেই। এ সময় কিছু সুস্থ জীবনবোধসম্পন্ন ফুটবল সংগঠক পিটার বাটলারের পাশে দাঁড়িয়েছেন। তাঁদের কর্মকাণ্ড এবং পরামর্শে নারী ফুটবল বড় ধরনের বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে। যা হোক, বাজে অতীতকে যত কম টেনে আনা হয় ততই ভালো। তাকাতে হবে সামনের দিকে। বাস্তবায়িত করার চেষ্টা করতে হবে জাতির বৃহত্তর স্বার্থ।

পিটারের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো কোচ কি চান, কেন চান, কিভাবে চান, এসব কিছুই খেলোয়াড়রা সহজেই বুঝতে পেরেছেন। তাঁরা বুঝতে পেরেছেন কোচের আসল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। কোচ বুঝতে পেরেছেন খেলোয়াড়দের মনমানসিকতার পাশাপাশি তাঁদের মেধা ও সম্ভাবনা। তিনি প্রথম থেকেই চেয়েছেন স্বাভাবিক খেলা। পরীক্ষা-নিরীক্ষা তো প্রস্তুতির অংশ। প্রথম থেকেই নারী ফুটবলাররা কোচের প্রশিক্ষণ কর্মসূচিকে দারুণভাবে উপভোগ করেছেন। কোচ তাদের মধ্যে আশ্বর্যজনক সাহস ও আত্মবিশ্বাসের জন্ম দিতে সক্ষম হয়েছেন। তিনি প্রত্যেকের ‘আনলিমিটেড’ সম্ভাবনাকে নাচিয়ে তোলার পাশাপাশি তাদের মধ্যে নতুন স্বপ্নের জন্ম দিতে সক্ষম হয়েছেন। তিনি তাদের বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন কেন সব সময় প্রস্তুতি পর্ব বা ফ্রেন্ডলি ম্যাচে ফিফা র্যাংকিংয়ে এগিয়ে থাকা দলের সঙ্গে খেলার দরকার আছে। খেলোয়াড়দের মাঠের নৈপুণ্যের মাধ্যমে প্রমাণ করেছেন তিনি আর তাঁর নারী ফুটবল সৈনিকরা ‘রাইট ডাইরেকশনে’ আছেন। তবে আগামী দিনগুলোতে অনেক চ্যালেঞ্জও আছে। প্রয়োজনীয় চাহিদাগুলো পূরণ না করতে পারলে সম্ভাবনাময় ফুটবল সমস্যায় পড়ে যেতে পারে।

‘গ্রাউন্ড ব্রেকিংয়ের’ কাজটা কোচ পিটার করেছেন। যেটি আগে কখনো করা হয়নি। বিভিন্ন পর্যায়ে নারী ফুটবলে কোচরা উল্লেখ করার মতো অবদান রেখেছেন। তবে প্রত্যেকের একটি সীমাবদ্ধতা আছে। এটি মেনে নিতে হবে। যে কাজের জন্য যিনি যোগ্য তাকেই বেছে নিতে হবে খেলার ভালো চাইলে। ‘অ্যাবিলিটি’ আর ‘অ্যাটিটিউড’ মাঠে এবং মাঠের বাইরে এর তো কোনো বিকল্প নেই। কোচ খেলোয়াড়দের কাছে চাচ্ছেন ‘হাই ইনটেনসিটি’ এবং ‘হাই প্রেস’ ফুটবল। পিটার আমাকে বলেছেন, ‘মেয়েরা আমাকে বারবার উসকে দিচ্ছে। এরাই আমাদের ভবিষ্যৎ। এদের মানসিকতা হলো সত্যি ‘গোল্ড’। তারা দেশের জন্য সব কিছু করতে প্রস্তুত। প্রয়োজন শুধু তাদের পাশে দাঁড়ানো। বড় স্বপ্ন তখনই বাস্তবে বাস্তবায়িত হবে—যখন মাঠ এবং মাঠের বাইরে সবাই ফুটবলারদের পাশে দাঁড়াবেন।

আমরা সবাই নারী ফুটবলে সাফল্য দেখতে চাই। চাই নারী ফুটবলারদের সাফল্যের দোলায় দোল খেতে। আমরা হয়তো জানি না কোন পরিবেশে, কোন ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলা করে আঞ্চলিক পর্যায়ে বয়সভিত্তিক এবং জাতীয় দল নৈপুণ্য প্রদর্শন করে চলেছে। সত্যি কথা বলতে কি আমরা এরই মধ্যে সীমাবদ্ধতায় আটকে পড়েছি। এখান থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন ভবিষ্যতের জন্য পরিকল্পিত উদ্যোগ।

এশিয়ান কাপে কোয়ালিফাই করে দেশে ফেরার সময় গভীর রাতে হাজার হাজার মানুষ নারীদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। এটি ইতিবাচক। তবে প্রয়োজন হলো সর্বমহলের সহযোগিতা ও সমর্থন। উচ্ছ্বাস আর সুন্দর সুন্দর কথা বলে তো নারী ফুটবলে কোনো লাভ হবে না, যদি না এই ফুটবলের পাশে না দাঁড়ানো হয়। নারী ফুটবলের জন্য যেটি দরকার সেটি হলো সরকারের শতভাগ সমর্থন, সাহায্য ও সহযোগিতা। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর নারী দল এশিয়ান কাপে কোয়ালিফাই করেছে প্রথমবারের মতো, এর আগে সাউথ এশিয়ান ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে দ্বিতীয়বারের মতো চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। কিছুদিন আগে অনূর্ধ্ব-২০ ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে নারী দল। অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে লিখিতভাবে নারী ফুটবলের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা এবং তার সমাধানের জন্য আবেদন করা হয়েছিল, কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। দুঃখজনক হলেও সত্য যে ২০১৮ থেকে ঢাকা ব্যাংক ছাড়া আর তেমন কোনো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান নারী ফুটবলে এগিয়ে আসেনি। বাণিজ্যিক স্পন্সর নারী ফুটবলে খুব দরকার।

ভাবা যায়, নারী দল এশিয়ান কাপে কোয়ালিফাই করেছে। দক্ষিণ এশিয়ার গণ্ডি ছাড়িয়ে এশিয়া মহাদেশের ফুটবলে প্রবেশ করেছে। সেই বাংলাদেশ নারী দলের কোনো ফুটবল কাঠামো নেই। অনুশীলন করার জন্য সারা দেশে একটিও ফুটবল প্র্যাকটিস গ্রাউন্ড নেই। নেই পৃথক আধুনিক জিমনেসিয়াম। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে থাকতে হয় মেয়েদের আবাসিক ক্যাম্পে। খেলোয়াড়দের ফুটবল নিউট্রেশনে আছে প্রচণ্ড ঘাটতি। অর্থের অভাবে নারী দল নিয়মিতভাবে বিদেশে গিয়ে শক্তিশালী প্রতিপক্ষের বিপক্ষে খেলতে পারে না। দেশে নারীদের লীগ নিয়মিতভাবে অনুষ্ঠিত হয় না। ক্লাবগুলো অনেক কথা বললেও নারী দল গঠনের ক্ষেত্রে সব সময় পিছু হটে চলেছে বিভিন্ন কারণে। দীর্ঘ সময় পেশাদার নারী লীগ অনুষ্ঠিত না হলে তো দেশের বাইরে এএফসি নারী কম্পিটিশনের কিছু কিছু দরজা সব সময় বন্ধ থাকবে। এত প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও আন্তর্জাতিক ফুটবলে নৈপুণ্য প্রদর্শন করে চলেছেন নারী ফুটবলাররা তারা কি সত্যি সবাই জাদুকর।

লেখক : কলামিস্ট ও বিশ্লেষক। সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি, এআইপিএস এশিয়া। আজীবন সদস্য, বাংলাদেশ স্পোর্টস প্রেস অ্যাসোসিয়েশন। প্যানেল রাইটার, ফুটবল এশিয়া

সর্বশেষ

জনপ্রিয়