বুধবার , ০৬ আগস্ট ২০২৫
Wednesday , 06 August 2025
১১ সফর ১৪৪৭

আখলাক আহমদ

প্রকাশিত: ১৭:৩৯, ৩১ জুলাই ২০২৫

জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে ঢাকায় যুদ্ধবিমান ঘাঁটি থাকা জরুরি

জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে ঢাকায় যুদ্ধবিমান ঘাঁটি থাকা জরুরি
ছবি: সংগৃহীত

সমপ্রতি রাজধানীর মাইলস্টোন স্কুলে মর্মান্তিক বিমান দুর্ঘটনায় বহু শিক্ষার্থী, শিক্ষকসহ আরো অনেকের মৃত্যু হয়েছে। অনেকে এখনো হাসপাতালে কাতরাচ্ছে। দুর্ঘটনায় তরুণ বৈমানিকেরও মৃত্যু হয়েছে। হতাহতের এই ঘটনা জাতির হৃদয়কে রক্তাক্ত করেছে।

এই দুর্ঘটনার পর সবচেয়ে বড় প্রশ্নটি উচ্চারিত হচ্ছে তা হলো : কেন ঢাকার মতো জনবহুল শহরে এখনো বাংলাদেশ বিমানবাহিনী যুদ্ধবিমান পরিচালনা করে? ঢাকার মাঝখানে এমন বিমানঘাঁটি থাকা উচিত নয়, কারণ তা জননিরাপত্তার জন্য হুমকি। কেউ বলছেন, বিমানঘাঁটি সরিয়ে ফেলা হোক রাজধানীর বাইরের কোনো জেলায়।

কিন্তু প্রশ্ন হলো, রাষ্ট্রের অস্তিত্ব, নিরাপত্তা এবং ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতা বিবেচনায় এই দাবিগুলো কতটুকু যৌক্তিক? যে মানুষরা সামরিক কৌশল, প্রতিরক্ষাবিজ্ঞান বা আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা পরিসরের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত নয়, তাদের কাছে এসব প্রশ্নের উত্তর স্বাভাবিকভাবেই অস্পষ্ট। তবে এই অস্পষ্টতা দূর না করা হলে শুধু আবেগ দিয়ে ত্বরিত কোনো সিদ্ধান্ত রাষ্ট্রের জন্য বিপর্যয়কর হয়ে দাঁড়াতে পারে।

ইতিহাস, বাস্তবতা এবং আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটের আলোকে আলোচনাটি খুবই জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঢাকা শুধু বাংলাদেশের রাজধানী নয়, এটি দেশের রাজনৈতিক, প্রশাসনিক এবং কৌশলগত কেন্দ্রবিন্দু। বিশ্বের যেকোনো রাষ্ট্রের মতো বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা পরিকল্পনার মূলস্তম্ভ হলো রাজধানী এবং এর আশপাশের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা বা স্থলচিহ্নের সুরক্ষা। সেনা সদর, বিমানবাহিনী সদর, নৌবাহিনী সদর, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, রাষ্ট্রপতির বাসভবন, সংসদ ভবন, শীর্ষ মন্ত্রণালয়গুলো এবং কূটনৈতিক এলাকা—সবই ঢাকায় অবস্থিত।

আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা তত্ত্বে একে বলা হয় ‘সেন্টার অব গ্র্যাভিটি’ (সিজি) অর্থাৎ একটি রাষ্ট্রের হৃিপণ্ড। যেকোনো শত্রুর প্রধান লক্ষ্য হয় এই সিজিকে অক্ষম বা ক্ষতিগ্রস্ত করা। তাই এজাতীয় কেন্দ্রের সুরক্ষা সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পায়। আর এই সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্যই ঢাকার আকাশে যুদ্ধবিমান পরিচালনা করা হয়।

কেউ কেউ বলেন যুদ্ধবিমানগুলো ঢাকা থেকে সরিয়ে যশোর, কক্সবাজার ও লালমনিরহাটে নিয়ে যাওয়া হোক।

কিন্তু এই ধারণাটি বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খায় না। আন্তর্জাতিক সামরিক অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, বহিঃরাষ্ট্র থেকে আমাদের সিজি-ও যে দূরত্ব, তাতে যেকোনো শত্রু যুদ্ধবিমান সীমান্ত অতিক্রম করে ঢাকায় পৌঁছতে পারবে পাঁচ থেকে সাত মিনিটের মধ্যেই। অন্যদিকে দূরবর্তী ঘাঁটি থেকে যুদ্ধবিমান প্রস্তুত হয়ে আকাশে উঠতে কমপক্ষে দুই থেকে চার মিনিট লাগে এবং এরপর টার্গেটে পৌঁছতে আরো সময় প্রয়োজন হয়। এই সময়সীমায় শত্রু আক্রমণ করে চলে যেতে পারবে আর আমাদের প্রতিরোধব্যবস্থা তখনো প্রস্তুতই হতে পারবে না। তাই প্রতিরোধ করতে হলে রাজধানীর আশপাশেই কুইক রি-অ্যাকশন অ্যালার্ট (কিউআরএ) প্রস্তুতি থাকা অপরিহার্য।
এই প্রেক্ষাপটে ঢাকায় যুদ্ধবিমান ঘাঁটি রাখা এবং পরিচালনা শুধু যুক্তিযুক্ত নয়, বরং জরুরি। এর চেয়েও বড় যে কারণটি অনেকেই উপেক্ষা করেন—ভৌগোলিক সীমাবদ্ধতা। বাংলাদেশ একটি অদ্ভুত ভৌগোলিক বাস্তবতায় ঘেরা। আমাদের প্রতিরক্ষা গভীরতা (ডিফেন্স ইন ডেপথ) সীমিত। ফলে একবার সীমান্ত পেরিয়ে শত্রু ঢুকে পড়লে রাজধানী ঢাকায় পৌঁছতে সময় লাগে না। তাই শত্রুকে ঠেকাতে রাজধানীর কাছেই বিমানবাহিনীর সক্রিয় উপস্থিতি অপরিহার্য।

এই বাস্তবতায় অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, দুর্ঘটনায় বেসামরিক ক্ষয়ক্ষতির জন্য দায় কার? এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বাস্তবতা সবার জানা দরকার। কুর্মিটোলা বিমানঘাঁটির রানওয়ে, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সঙ্গেই যৌথভাবে ব্যবহৃত। রানওয়ের শেষ সীমা থেকে যেসব বসতি, স্কুল, হাসপাতাল, হোটেল বা আবাসিক এলাকা গড়ে উঠেছে, তা গড়ে উঠেছে বেসরকারি দখল, অব্যবস্থাপনা ও প্রশাসনিক দুর্বলতার কারণে। বিশ্বজুড়ে যেকোনো বিমানবন্দরের পাশে অ্যাপ্রচ জোন নামক এলাকা থাকে, যেখানে স্থায়ী বসতি বা জনবসতি গড়ে তোলা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। এটি আন্তর্জাতিক উড্ডয়ন নিরাপত্তা নীতিমালার অংশ। কিন্তু ঢাকায় এই নিয়ম মানা হয়নি। যখন কুর্মিটোলা ঘাঁটি বা বিমানবন্দর নির্মিত হয়েছিল, তখন পুরো এলাকা ছিল নির্জন। ধীরে ধীরে জনবসতি গড়ে উঠেছে এবং বিস্ময়করভাবে রাজউক, সিটি করপোরেশন কিংবা প্রভাবশালী রাজনৈতিক চাপে ঘাঁটির ঠিক সীমানা ঘেঁষেই উঁচু বহুতল ভবনের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এর জন্য দায়ী দেশের দীর্ঘদিনের দুর্বল নগর পরিকল্পনা ও স্থানীয় কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতা। এই সিদ্ধান্তগুলোর দায় কখনোই বিমানবাহিনী বা ঘাঁটির নয়।

বিভিন্ন দেশে কিভাবে সামরিক বাহিনীর অবস্থান নির্ধারিত হয়, তা বিশ্লেষণ করলে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট আরো পরিষ্কার হয়ে ওঠে। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে যেমন পেন্টাগন অবস্থিত, তেমনি চীন তাদের রাজধানী বেইজিংয়ের মধ্যে রেখেছে গুরুত্বপূর্ণ বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ইউনিট। রাশিয়ার মস্কো, ভারতের দিল্লি, পাকিস্তানের ইসলামাবাদ কিংবা ইসরায়েলের তেল আবিব—সব রাজধানীতেই রয়েছে অত্যন্ত শক্তিশালী সামরিক উপস্থিতি।

ভারতের দিল্লিতে রয়েছে হিন্দন এয়ার বেইস, সিটি সেন্টার থেকে মাত্র ২০ কিলোমিটার দূরে। আমেরিকার জয়েন্ট বেইস এসডিউস অবস্থিত ওয়াশিংটন ডিসির কাছেই। লন্ডন, প্যারিস, তেল আবিব—সব বড় শহরের পাশে সামরিক বিমানঘাঁটি বিদ্যমান। কারণ রাষ্ট্রের কেন্দ্রবিন্দু যেকোনো সময়ই শত্রুর প্রথম হামলার লক্ষ্যবস্তু। আর প্রতিক্রিয়া জানানোর জন্য সেনাবাহিনী বা বিমানবাহিনীকে থাকতে হয় রাজধানীর আশপাশেই।

আধুনিক সমরবিদ্যায় ও অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, রাজধানীর প্রতিরক্ষায় বিমানবাহিনীর ভূমিকাই মুখ্য। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৯১ সালের উপসাগরীয় যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র প্রথমেই ইরাকের রাজধানী বাগদাদের সামরিক ও রাজনৈতিক অবকাঠামো ধ্বংস করে দেয়। কারণ বাগদাদের পতন মানেই ছিল ইরাকের শাসনব্যবস্থার পতন। আবার ২০০৩ সালে দ্বিতীয় ইরাক যুদ্ধেও দেখা গেছে, ‘বাগদাদ ফাস্ট’ কৌশলেই মার্কিন বাহিনী এগিয়েছে।

তাই বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা কৌশলগতভাবে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। শহরে বিমানবাহিনীর অপারেশনাল সক্ষমতা থাকা কোনো বিলাসিতা নয়, এটি অপরিহার্য নিরাপত্তাকৌশল। এটি বন্ধ করা বা সরিয়ে ফেলা মানে শত্রুর আক্রমণের জন্য নিজে হাতে ঢাকার দরজা খুলে দেওয়া। আন্তর্জাতিক বিমান নিরাপত্তা সংস্থা ICAO এবং সামরিক কৌশলবিদরা একমত যে রাজধানীর এক্সক্লুসিভ এয়ার ডিফেন্স আইডেন্টিফিকেশন জোন  (ADIZ) তৈরি করাই আধুনিক যুদ্ধকৌশলের মূলকথা।

বর্তমান যুগে যুদ্ধ আর আগের মতো সীমান্তে গুলিবর্ষণে সীমাবদ্ধ নেই। এখন যুদ্ধ হয় ড্রোন, স্যাটেলাইটনির্ভর গাইডেড মিসাইল, ইলেকট্রনিক জ্যামার ও সাইবার হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে। আঞ্চলিক শক্তিধর দেশের হাতে রয়েছে অতি উন্নত প্ল্যাটফর্ম। শত্রু দেশের আধুনিক যুদ্ধবিমান কয়েক মিনিটের মধ্যে বাংলাদেশের যেকোনো স্থানে ঢুকে আঘাত হানতে পারে। কাজেই আমাদেরও প্রতিরোধে দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানানোর ক্ষমতা থাকতে হবে। এর জন্য রাজধানী ঢাকায়ই আমাদের ‘ ready to scramble’ ফাইটার জেট থাকা অপরিহার্য।

আরেকটি বিষয় হলো, ঢাকার আশপাশে একটি যুদ্ধবিমান উপস্থিত থাকার মানে শুধু প্রতিরক্ষা নয়, শত্রুর জন্য এটি একটি ‘deterrence signal’। শত্রু জানে, ঢাকায় প্রবেশ করলে কয়েক মিনিটের মধ্যে পাল্টা আক্রমণ আসবে—এই ভীতিটাই প্রতিরোধের শক্তি। একে বলা হয় ‘Strategic Posturing’। তাই যুদ্ধবিমান ঢাকায় না থাকলে কৌশলগতভাবে আমরা এক ধাপে দুর্বল হয়ে পড়ি।

যখন বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটে, তখন জনমনে আবেগ প্রবল হয়ে ওঠে। এই আবেগকে পুঁজি করে অনেকেই ‘টক শো-তথ্য বিশ্লেষক’ হয়ে ওঠেন, যাঁরা সামরিক কৌশল বা ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে কখনোই যুক্ত ছিলেন না। এই ‘তথাকথিত’ বিশ্লেষকদের কথায় জাতীয় নিরাপত্তা নীতিমালায় হস্তক্ষেপ হোক—এটি কোনো জাতির জন্য শুভ লক্ষণ নয়। বিমান দুর্ঘটনা নিঃসন্দেহে শোকাবহ, কিন্তু সেই শোক যদি বাস্তবতা অস্বীকার করার পথে নিয়ে যায়, তবে তা আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত হয়। বরং প্রয়োজন সঠিক তদন্ত, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার এবং আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা নীতির আলোকে অবকাঠামো উন্নয়ন। স্মরণ করা যেতে পারে যে ঢাকায় এক বিরিয়ানি হাউসে অগ্নিদুর্ঘটনায় প্রায় ৪০ জন মারা গিয়েছিল। তখন কেউ দাবি করেননি ঢাকা থেকে সব বিরিয়ানি দোকান সরিয়ে ফেলতে হবে।

বিমানবন্দরের আশপাশের এলাকায় বা অ্যাপ্রচ পথে যেসব স্কুল, হোটেল, বসতি, হাসপাতাল বা মার্কেট গড়ে উঠেছে, সেগুলো আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী অনুমোদিত হওয়ার কথা নয়। এগুলোর অনুমোদন যারা দিয়েছে, দায়ী তারা। এই অনিয়ন্ত্রিত নগরায়ণের দায় কোনোভাবেই বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর নয়।

সমাধান হতে পারে একটি স্থায়ী ‘ Airport Planning and Protection Act’ , যা আন্তর্জাতিক সিভিল এভিয়েশন সংস্থার (ICAO) গাইডলাইন অনুযায়ী তৈরি হবে, যাতে বিমানবন্দর ও সামরিক ঘাঁটির পাশে দু-তিন কিলোমিটার পর্যন্ত জনবসতি, স্কুল বা বহুতল ভবন গড়ে উঠতে না পারে। এ ছাড়া বিমানবাহিনীর মতামত ছাড়া এভিয়েশন অ্যাপ্রচ জোনে কোনো অবকাঠামোর অনুমোদন দেওয়া যাবে না।

এ ছাড়া সরকার যদি চায়, তাহলে ঘাঁটিগুলোকে আধুনিকায়ন করে আরো noise reduction প্রযুক্তি ব্যবহার করে বা বিকল্প ট্রেনিং রুট তৈরি করে দুর্ঘটনার ঝুঁকি কমাতে পারে। কিন্তু এর অর্থ কখনোই ঢাকায় যুদ্ধবিমান ঘাঁটি বন্ধ করে দেওয়া নয়।

মাইলস্টোন স্কুলের দুর্ঘটনা নিঃসন্দেহে মর্মান্তিক। কিন্তু দুর্ঘটনার আবেগে যদি একটি রাষ্ট্র কৌশলগত ভুল সিদ্ধান্ত নেয়, তবে তা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বড় হুমকি তৈরি করে। যুদ্ধবিমান, সামরিক ঘাঁটি কিংবা প্রতিরক্ষানীতি গড়ে ওঠে শুধু আবেগ দিয়ে নয়, তথ্য, ইতিহাস ও কৌশলগত বাস্তবতার ভিত্তিতে। একটি জাতির আত্মবিশ্বাস, প্রস্তুতি ও নিরাপত্তা আসে তার প্রতিরক্ষা অবকাঠামো থেকে। ঢাকায় যুদ্ধবিমান ঘাঁটি রাখা কোনো বিলাসিতা নয়, এটি আমাদের সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য একটি কৌশলগত দায়।

লেখক : প্রবাসী আইনজীবী, ইংল্যান্ড
 

সর্বশেষ

জনপ্রিয়