অব্যবস্থাপনায় ‘আটকে’ যাচ্ছে বিমানের ডানা, যাত্রী হারানোর শঙ্কা

ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন এলেও অব্যবস্থাপনা, যান্ত্রিক ত্রুটি, শিডিউল বিপর্যয়, অপ্রয়োজনীয় কেনাকাটা ও অনিয়মে জর্জরিত অবস্থায় আছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। এতে আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি ও যাত্রী আস্থা দুটোই মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ নানা পদে নতুন কর্মকর্তারা দায়িত্ব নিলেও এক বছরের মধ্যে পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। বরং অদৃশ্য সিন্ডিকেটের প্রভাব ও নানা প্রতিবন্ধকতায় নতুন ব্যবস্থাপনার নেওয়া উদ্যোগ আটকে যাচ্ছে। প্রকৌশল, ম্যানেজমেন্ট, অর্থনীতি ও যাত্রীসেবার নানা খাতেই চলছে অনিয়ম ও শৈথিল্য।
বিমান সূত্র জানায়, বহরে বর্তমানে ১৯টি উড়োজাহাজ থাকলেও অধিকাংশেই নিয়মিত ত্রুটি ধরা পড়ছে। গত এক মাসে অন্তত ১৬ বার মাঝ আকাশে বা অবতরণের পর সমস্যা দেখা দিয়েছে। আধুনিক ড্রিমলাইনার ও বোয়িং ৭৭৭ মডেলের বিমানেও বারবার ত্রুটি ধরা পড়ছে। ফলে সময়মতো ফ্লাইট ছাড়তে না পারায় যাত্রীদের ভোগান্তি বেড়েছে, পাশাপাশি যাত্রীসংখ্যাও কমছে।
অভিযোগ রয়েছে, প্রকৌশল বিভাগের কিছু কর্মকর্তা ইচ্ছাকৃতভাবে মেরামত কার্যক্রম দীর্ঘায়িত করছেন, যাতে যন্ত্রাংশ কেনায় কমিশন ও বিদেশ সফরের সুযোগ মেলে। কোয়ালিটি এসুরেন্স বিভাগ থেকেও যথাযথ নজরদারি না থাকায় একই সমস্যা বারবার ঘটছে।
শুধু যান্ত্রিক ত্রুটি নয়, অর্থনৈতিক খাতেও চলছে অনিয়ম। সম্প্রতি প্রায় ৪ কোটি টাকার ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সফটওয়্যার (এমআইএস) কেনার ক্ষেত্রে ক্রয় নীতিমালা উপেক্ষা করে এয়ারলাইন্স ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ততা নেই এমন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করা হয়। এ ছাড়া পূর্ববর্তী এক ঘটনায় ভুল লেনদেনে ৫ লাখ ডলার বিদেশে চলে গেলেও তা ফেরত আনা হয়নি বলে অভিযোগ আছে। এমনকি স্থায়ী আমানতে বিমানের কোটি কোটি টাকা ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাংকে রেখে ক্ষতির মুখে ফেলা হয়েছে।
রুট ব্যবস্থাপনাতেও ব্যর্থতা দেখা দিয়েছে। বাজার যাচাই করে চালু হওয়া ঢাকা-জাপান নারিতা রুট মাত্র কয়েক মাসেই বন্ধ হয়ে গেছে। যাত্রী সংকট নয়, বরং উড়োজাহাজ সংকটের কারণে এ রুট বন্ধ করা হয়েছে বলে জানা যায়। একইভাবে ঢাকা-রোম রুটেও সেবার মানের অবনতি, খাবার পরিবহনে অব্যবস্থাপনা ও দায়িত্বে গাফিলতির অভিযোগ রয়েছে। এসব কারণে বিদেশি বিমানবন্দরেও বিমান বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হচ্ছে।
অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলাও নষ্ট হচ্ছে। নারী কর্মীদের যৌন হয়রানি সংক্রান্ত একাধিক অভিযোগের পরও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। গত মে মাসে ঢাকা-দুবাই ফ্লাইটে চিফ পার্সারের বিরুদ্ধে নারী সহকর্মী লিখিত অভিযোগ দিলেও বিচার পাননি। আরও কয়েকজন নারী কর্মী একই ধরনের অভিযোগ করলেও কার্যকর ব্যবস্থা হয়নি।
চোরাচালান রোধেও প্রশাসন ব্যর্থ। সম্প্রতি এক কেবিন ক্রু অবৈধভাবে মোবাইল ফোন এবং অপর এক সিনিয়র ফ্লাইট পার্সার স্বর্ণ চোরাচালান করতে গিয়ে ধরা পড়েন। ইউনিফর্ম পরে ধূমপানের মতো শৃঙ্খলাভঙ্গের ঘটনাও সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হলেও অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে শাস্তি হয়নি।
বিমানের মুখপাত্র আল মাসুদ খান দাবি করেন, উড়োজাহাজ সবসময় সার্টিফায়েড ইঞ্জিনিয়ার দ্বারা যাচাইয়ের পর উড্ডয়ন করে এবং ত্রুটি ধরা পড়লে তা দ্রুত মেরামত করা হয়। তবে সাম্প্রতিক কিছু ঘটনায় বিষয়টি নিয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে। যাত্রী নিরাপত্তা ও সেবার মান নিশ্চিত করতেই প্রতিষ্ঠান সবসময় সচেষ্ট বলে তিনি জানান।
তবে বাস্তবে যান্ত্রিক ত্রুটি, অনিয়ম, আর্থিক অনিয়ম, সেবা অবনতি ও অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলার কারণে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের আকাশে ডানা মেলা ক্রমেই কঠিন হয়ে পড়ছে। এতে যাত্রী আস্থা হারানোর পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারেও প্রতিযোগিতা ধরে রাখা নিয়ে শঙ্কা বাড়ছে।