বুধবার , ০৬ আগস্ট ২০২৫
Wednesday , 06 August 2025
১০ সফর ১৪৪৭

ডেস্ক নিউজ

প্রকাশিত: ১৬:২৩, ৪ আগস্ট ২০২৫

চাঁদা দিয়ে বিশেষ টোকেন সংগ্রহ করলে ডাকাত থেকে রক্ষা পান জেলেরা।

চাঁদা দিয়ে বিশেষ টোকেন সংগ্রহ করলে ডাকাত থেকে রক্ষা পান জেলেরা।

ডাকাতের ভয়ে অনেক জেলেই রাতে নদী ও সাগর মোহনায় মাছ শিকার করতে যাচ্ছেন না। এতে ব্যবসা নিয়ে চিন্তিত জেলে ও মৎস্য আড়ৎদাররা। তবে চাঁদা দিয়ে বিশেষ টোকেন সংগ্রহ করলেই ডাকাতদের থেকে রক্ষা পান জেলেরা, মাছ ধরতে পারেন সাগরে।

জেলেদের দাবি, নদী ও সাগর মোহনায় মাছ শিকার করতে হলে ডাকাতদের থেকে টাকার বিনিময়ে সংগ্রহ করতে হয় টোকেন। আর টোকেন ছাড়া গেলেই রাতে হামলা, লুটপাট ও জেলে অপহরণের ঘটনা ঘটে। পরে মোটা অঙ্কের বিনিময়ে মেলে মুক্তি। ভোলার মনপুরায় গত এক সপ্তাহ ধরে জেলেদের জালে দেখা মিলছে কাঙ্ক্ষিত ইলিশ। এতে হাসি ফুটেছে জেলেদের মুখে। কিন্তু সেই হাসি দীর্ঘস্থায়ী হতে পারলো না। জেলেদের মাঝে দেখা দিয়েছে ডাকাত আতঙ্ক।

সরেজমিনে ভোলার মনপুরা উপজেলার বিভিন্ন মৎস্য ঘাটে গিয়ে জেলেদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত ২৬ জুলাই থেকে এ পর্যন্ত ১০টির বেশি ট্রলারে ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। ডাকাতরা অপহরণ করে নিয়ে গেছে ৫ জেলেকে। পরে ডাকাতদের দাবিকৃত মুক্তিপণ দিয়ে ফিরেছেন ওই জেলেরা। কিন্তু ডাকাতদের কাছ থেকে উদ্ধার করা যায়নি মাছ ও জাল। মনপুরা উপজেলার ৫টি ইউনিয়নে প্রায় ৫০ হাজার জেলে রয়েছেন, যারা নদী ও সাগর এবং সাগর মোহনায় মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। কিন্তু বর্তমানে তাদের মাঝে দেখা দিয়েছে ডাকাত আতঙ্ক।

ডাকাতদের কাছে অপহরণের পর মুক্তিপণ দিয়ে ফিরে আসা মনপুরা উপজেলার দক্ষিণ সাকুচিয়া ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের মাঝের ঘাটের জেলে মো. গিয়াস উদ্দিন মাঝি জানান, গত ২৭ জুলাই গভীর রাতে তিনিসহ ১০ জেলে মনপুরা ও হাতিয়া উপজেলার মাঝামাঝিতে মেঘনা নদীতে মাছ শিকারে যান। এসময় ১৫-২০ জনের একটি ডাকাত দল তাদের ওপর আক্রমণ করে। পিস্তল ও দেশীয় ধারালো অস্ত্র নিয়ে তাদের চারদিক ঘিরে ফেলে। এরপর তাদের ওপর হামলা চালিয়ে মাছ ও জাল লুট করে। পরে তাকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে অপহরণ করে নিয়ে যায়।

তিনি আরও জানান, ডাকাতরা তাকে কোথায় নিয়ে গেছে সেটি তিনি চিনতে পারেননি। পরে সকালের দিকে তার মুক্তির জন্য মুক্তিপণ দাবি করে। তার মোবাইল ফোন থেকে ডাকাতরা আড়ৎদারের কাছে ১ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। এরপর দরদাম করে ডাকাতদের হাত-পা ধরে ৩০ হাজার টাকায় তার মুক্তি হয়। আড়তদার ডাকাতদের মোবাইলে বিকাশ ও নগদ অ্যাকাউন্ট টাকা পাঠালে তাকে পরের দিন রাতে মুক্তি দেয়।

অপহরণের পর মুক্তি পাওয়া একই এলাকার জেলে মো. রাজিব মাঝি জানান, তাদেরও একই রাতে ডাকাতরা অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে অপহরণ করে নিয়ে যায়। মারধরের পর মুক্তিপণ দাবি করে পরিবারের কাছে। পরে ২৫ হাজার টাকা মুক্তিপণে মুক্তি পান তিনি। মুক্তিপণ দেওয়ার পরদিন রাতে তাকে তার ট্রলারসহ ডাকাতরা মাঝ নদীতে ছেড়ে দেয়। তিনি আরও জানান, ছেড়ে দেওয়ার সময় তার হাতে একটি টোকেন ধরিয়ে দেয়। টোকেনে তার নাম ও ডাকাতদের নামের সংক্ষেপ এবং স্বাক্ষর ছিল। ডাকাতরা বলে আবার কেউ ধরলে এই টোকেন দেখালে তাকে ছেড়ে দিবে। এছাড়াও এই টোকেন দিয়ে এ বছর মাছ ধরতে পারবেন তিনি। তবে আগামী বছর আবারো টোকেন লাগবে।

মাঝের ঘাটের জেলে মো. হাসান মাঝি ও নজরুল মাঝি জানান, কয়েকদিনে তাদের ঘাটের ৩ জেলেকে অপহরণ করেছে ডাকাত দল। ট্রলারে ডাকাতি ও লুটপাট হয়েছে। মোটা অঙ্কের মুক্তিপণের বিনিময়ে জেলেরা ফিরেছেন। তাই তারা অনেক ভয়ের মধ্যে আছেন। ডাকাতদের ভয়ে রাতে নদীতে যাচ্ছেন না তারা।

দক্ষিণ সাকুচিয়া ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের জেলে মো. হাফিজ মাঝি ও মো. হারুন মাঝি জানান, এ বছর ভরা মৌসুম শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ডাকাতরা টোকেন বিক্রি শুরু করেছে। টোকেন যারা সংগ্রহ না করে তাদের ট্রলারে ডাকাতি, হামলা, লুটপাট ও অপহরণ হয়। তাই আমরা বাধ্য হয়ে ডাকাতদের কাছ থেকে ৫-১০ হাজার টাকার বিনিময়ে টোকেন সংগ্রহ করেছি।  তবে কীভাবে টোকেন সংগ্রহ করেছেন সে বিষয়ে মুখ খোলেননি তারা। শুধু বলেন, ডাকাতদের সোর্স প্রতিটি মৎস্য ঘাটেই রয়েছে। জেলে মো. সবুজ মাঝি ও বিল্লাল মাঝি জানান, মনপুরা উপজেলার অর্ধেকেরও বেশি জেলে আড়তদার থেকে টাকা ধার নিয়ে টোকেন সংগ্রহ করেছেন।

মাঝির ঘাটের আড়তদার মো. আকতার শিকদার ও মো. হোসেন জানান, তারা ঢাকা ও চাঁদপুরের আড়তদার থেকে মোটা অংশের টাকা দাদন এনে জেলেদের দিয়েছেন। কিন্তু বর্তমানে জেলেরা ডাকাত আতঙ্কে রয়েছে। এতে করে ঠিকমতো মাছ শিকার করতে পারছেন না। এমন অবস্থা চলতে থাকলে তারা লোকসানের মুখে পড়বেন। তারা আরও জানান, নদী ও সাগর মোহনায় ডাকাতদের বেশ কয়েকটি বাহিনী রয়েছে। যদি কোস্টগার্ড, নৌ পুলিশ ও পুলিশ টহল জোরদার হয় তাহলে জেলেরাও মাছ ধরতে পারবে এবং তাদের ব্যবসা ঠিকঠাক চলবে। এজন্য প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেন তারা।

মনপুরা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আহসান কবীর জানান, ডাকাতির ঘটনায় কেউ এখন পর্যন্ত থানায় লিখিত অভিযোগ করেনি। অভিযোগ পেলেই ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন তারা।

কোস্টগার্ড দক্ষিণ জোনের স্টাফ অফিসার অপারেশন লে. কমান্ডার রিফাত আহমেদ জানান, জেলেদের জালে কাঙ্ক্ষিত পরিমাণ মাছ ধরা পড়ায় ডাকাতির ঘটনা ঘটছে বলে জানতে পেরেছি। জেলেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কোস্টগার্ড বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। নদীতে নিয়মিত টহল ও তল্লাশি বৃদ্ধি করা হয়েছে। এছাড়াও ডাকাতদের ধরতে গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করা হয়েছে।

 

 

 

 

সর্বশেষ

জনপ্রিয়