মঙ্গলবার , ২৬ আগস্ট ২০২৫
Tuesday , 26 August 2025
০২ রবিউল আউয়াল ১৪৪৭

ডেস্ক নিউজ

প্রকাশিত: ১৭:১১, ২৫ আগস্ট ২০২৫

চীনের নতুন মেগা বাঁধে পানি যুদ্ধের আশঙ্কা ভারতের

চীনের নতুন মেগা বাঁধে পানি যুদ্ধের আশঙ্কা ভারতের

চীনের নতুন মেগা বাঁধ নির্মাণে ভারতে সৃষ্টি হয়েছে পানিযুদ্ধের আশঙ্কা। ভারত আশঙ্কা করছে, তিব্বতে পরিকল্পিত চীনের এই মেগা পানিবিদ্যুৎ বাঁধ শুষ্ক মৌসুমে তাদের নদীর পানিপ্রবাহ প্রায় ৮৫ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়ে দিতে পারে।

সোমবার (২৫ আগস্ট) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে বার্তাসংস্থা রয়টার্স।

বার্তাসংস্থাটি বলছে, চীনের নতুন মেগা বাঁধ নির্মাণের ফলে পানিপ্রবাহ কমে যাওয়ার বিষয়টি সম্পর্কে অবগত চারটি সূত্র রয়টার্সকে একথা বলেছে। এছাড়া ভারত সরকারের একটি বিশ্লেষণও দেখেছে রয়টার্স। এই আশঙ্কার পর দিল্লি দ্রুত নিজস্ব বাঁধ নির্মাণ পরিকল্পনা এগিয়ে নিচ্ছে, যাতে সম্ভাব্য ক্ষতি মোকাবিলা করা যায়।

রয়টার্স বলছে, ২০০০-এর দশকের শুরু থেকে ভারত তিব্বতের অঙ্গসি হিমবাহ থেকে প্রবাহিত নদীর পানিপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণের প্রকল্প বিবেচনা করছে। এই নদী থেকেই চীন, ভারত ও বাংলাদেশ মিলিয়ে ১০ কোটিরও বেশি মানুষ জীবন-জীবিকা নির্বাহ করে। তবে এর আগে অরুণাচল প্রদেশের স্থানীয়দের তীব্র ও কখনও সহিংস বিরোধিতার কারণে বাঁধ প্রকল্পগুলো থেমে যায়।

স্থানীয়দের আশঙ্কা, বাঁধ নির্মিত হলে তাদের গ্রাম ডুবে যাবে এবং জীবনধারা ধ্বংস হয়ে যাবে।

তবে গত ডিসেম্বরে চীন ঘোষণা দেয়, তারা সীমান্তের একটি জেলায় বিশ্বের সবচেয়ে বড় পানিবিদ্যুৎ বাঁধ নির্মাণ করবে যেটি ইয়ারলুং জাংবো নদীর ভারতে প্রবেশের ঠিক আগে অবস্থিত। এ খবরেই উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে দিল্লি, কারণ ভারতের দীর্ঘদিনের কৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বী চীন — যাদের সঙ্গে অরুণাচল প্রদেশ নিয়ে সীমান্ত বিরোধ রয়েছে — নদীকে ‘অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। নদীটির উৎস অঙ্গসি হিমবাহে এবং ভারতে একে সিয়াং ও ব্রহ্মপুত্র নামে ডাকা হয়।

এমন অবস্থায় ভারতের বৃহত্তম পানিবিদ্যুৎ কোম্পানি গত মে মাসে সশস্ত্র পুলিশের পাহারায় আপার সিয়াং মাল্টিপারপাস স্টোরেজ ড্যামের সম্ভাব্য স্থানে জরিপ সামগ্রী নিয়ে যায়। এটি বাস্তবায়িত হলে তা হবে ভারতের সবচেয়ে বড় বাঁধ। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কার্যালয় এ বিষয়ে চলতি বছরের জুলাইতে বৈঠক ডেকেছিল বলে দুটি সরকারি সূত্র জানিয়েছে।

সরকারি বিশ্লেষণ অনুযায়ী, চীনের প্রকল্প সম্পন্ন হলে তারা প্রায় ৪০ বিলিয়ন ঘনমিটার পানি সরাতে পারবে, যা সীমান্তে ভারতের প্রাপ্ত পানির এক-তৃতীয়াংশের বেশি। এতে বিশেষ করে অ-বর্ষা তথা শুষ্ক মৌসুমে ভয়াবহ প্রভাব পড়বে। তবে ভারতের প্রস্তাবিত আপার সিয়াং বাঁধ ১৪ বিলিয়ন ঘনমিটার পানি সঞ্চয় করতে পারবে, যা শুষ্ক মৌসুমে ছেড়ে দিয়ে ক্ষতি কমাতে সাহায্য করবে। এতে গুয়াহাটি শহরে পানির ঘাটতি ২৫ শতাংশের বদলে ১১ শতাংশে নেমে আসতে পারে।

আরও একটি সুবিধা হলো ভারতের বাঁধ আংশিক খালি রাখলে (৩০ শতাংশ) চীন যদি হঠাৎ অতিরিক্ত পানি ছেড়ে দেয়, সেটি শোষণ করা সম্ভব হবে।

চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বলেছেন, প্রকল্পগুলো কঠোর বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা শেষে অনুমোদন পেয়েছে এবং তা ভাটির দেশগুলোর পানি, পরিবেশ বা ভূতত্ত্বের ক্ষতি করবে না। তিনি আরও দাবি করেন, চীন সবসময় দায়িত্বশীলভাবে সীমান্তবর্তী নদীর উন্নয়ন করেছে এবং ভারত ও বাংলাদেশের সঙ্গে দীর্ঘদিন যোগাযোগ ও সহযোগিতা বজায় রেখেছে।

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বা পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি। তবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস. জয়শঙ্কর গত ১৮ আগস্ট চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে এ উদ্বেগ উত্থাপন করেছিলেন।

এদিকে পাকিস্তান অভিযোগ করেছে, ভারতও পানি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। চলতি বছর দিল্লি ইসলামাবাদের সঙ্গে ১৯৬০ সালের পানি-বণ্টন চুক্তি স্থগিত করেছে এবং আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ নদীর পানিপ্রবাহ অন্যদিকে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করছে। যদিও আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল বলেছে, ভারতকে এ চুক্তি মেনে চলতে হবে, তবে দিল্লি মনে করে, ট্রাইব্যুনালের এই আদেশ দেওয়ার এখতিয়ার নেই।

উন্নয়ন নাকি ধ্বংস?

রয়টার্স বলছে, চলতি বছরের মে মাসে এনএইচপিসির কর্মীরা জরিপ সামগ্রী নিয়ে গেলে অরুণাচলের পারং গ্রামের বাসিন্দারা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। তারা মেশিনপত্র ভাঙচুর করে, একটি সেতু ধ্বংস করে এবং পুলিশের ক্যাম্প লুট করে। স্থানীয় আদি সম্প্রদায় সিয়াং নদীর তীরে ধান, কমলা ও মাল্টা চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করে।

আদিবাসীরা গ্রামীণ সড়কে প্রহরা বসিয়েছে যাতে এনএইচপিসি কর্মীরা সেখানে প্রবেশ করতে না পারে। এতে নিরাপত্তাকর্মীদের রাতের আঁধারে দীর্ঘপথ হেঁটে সম্ভাব্য সাইটে পৌঁছাতে হচ্ছে। প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে অন্তত ১৬টি আদি গ্রাম বিলীন হবে, প্রায় ১০ হাজার মানুষ সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

ওই সম্প্রদায়ের নেতারা বলছেন, প্রভাব পড়বে এক লাখেরও বেশি মানুষের জীবনে। স্থানীয় দোকানি ও দুই সন্তানের মা ওডনি পালো পাবিন বলছেন, “এই জমিতে আমাদের এলাচ, ধান, কাঁঠাল আর নাশপাতি আমাদের সন্তানদের শিক্ষার খরচ জোগায়। আমরা মরে গেলেও এই বাঁধ হতে দেব না।

অরুণাচলের মুখ্যমন্ত্রী — যিনি মোদির দলের সদস্য — এই প্রকল্পকে সমর্থন করেছেন এবং বলেছেন, চীনা বাঁধ অস্তিত্বের জন্য হুমকি। রাজ্য সরকার জানিয়েছে, বাঁধ নির্মিত হলে তা পানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে এবং হঠাৎ পানি প্রবাহ মোকাবিলায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ করবে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর সঙ্গে ক্ষতিপূরণ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে।

স্থানীয় এমপি আলো লিবাং — যিনি নিজেও আদি সম্প্রদায়ের সদস্য — বলেছেন, পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ পেলে লোকজনকে রাজি করানো সম্ভব। এনএইচপিসি শিক্ষা ও জরুরি অবকাঠামোতে ৩০ লাখ ডলারের বেশি খরচ করার পরিকল্পনা করছে, যাতে মানুষ পুনর্বাসনে রাজি হয়।

পরিস্থিতির কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে এবং সম্প্রতি তিনটি গ্রাম এনএইচপিসিকে বাঁধ-সংক্রান্ত কাজ করার অনুমতি দিয়েছে।

ভারতে অতীতে বড় বাঁধকে ঘিরে আন্দোলন দীর্ঘদিন প্রকল্প বিলম্বিত করেছে বা ছোট আকারে নামিয়ে এনেছে। আপার সিয়াং বাঁধ নির্মাণ শুরু হলেও শেষ হতে এক দশক লাগতে পারে, অর্থাৎ চীনের প্রকল্প আগে শেষ হয়ে যাবে। চীন আশা করছে ২০৩০-এর দশকের শুরুতে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হবে।

বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, ভূমিকম্পপ্রবণ তিব্বত ও অরুণাচলে বড় বাঁধ নির্মাণ ঝুঁকি বাড়াতে পারে।

ইউনিভার্সিটি অব অ্যারিজোনার গবেষক সায়নাংশু মডক বলেছেন, “এটি ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকায় তৈরি হচ্ছে, যেখানে অতিমাত্রায় আবহাওয়া বদলের ঘটনাও ঘটে। এতে ভূমিধস, হিমবাহ হ্রদ ফেটে বন্যা হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এসব কারণে বাঁধ-সংক্রান্ত নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ যৌক্তিক এবং ভারতকে অবশ্যই চীনের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনায় বসা উচিত।

সর্বশেষ

জনপ্রিয়