ঐকমত্য না হলে কমিশনের ওপর সিদ্ধান্তের ভার

গত বছর ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দায়িত্ব নেওয়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকার মৌলিক রাষ্ট্রীয় সংস্কার নিয়ে এগোতে গেলেও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারছে না। সরকারের গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশন বারবার বৈঠক করেও কাঠামোগত ইস্যুগুলোতে সমাধানে ব্যর্থ হচ্ছে। ইতোমধ্যে ১১টি সংস্কার প্রস্তাবের মধ্যে ৭টিতে আংশিক ঐকমত্য হলেও ৯টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে এখনো দ্বিমত বিদ্যমান।
সংস্কার পরিকল্পনার কেন্দ্রবিন্দু ‘জুলাই সনদ’ প্রকাশের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে ঐকমত্য কমিশন। তবে জুলাইয়ের শেষার্ধ শুরু হলেও এখনো চূড়ান্ত ঐকমত্যের সম্ভাবনা অস্পষ্ট। বৃহস্পতিবার কমিশনের সদস্যরা প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করে অগ্রগতির চিত্র তুলে ধরেন। প্রধান উপদেষ্টা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা দিলেও সময় ঘনিয়ে আসায় কমিশনের সহসভাপতির কণ্ঠে হতাশার সুর ধ্বনিত হয়েছে।
বিশেষভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাঠামো কেমন হবে, প্রধান উপদেষ্টা কে হবেন, সেই প্রক্রিয়ায় দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক মতবিরোধ প্রকট। বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী এবং এনসিপি এই বিষয়ে আলাদা আলাদা প্রস্তাব দিয়েছে। এ ছাড়া দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্ট গঠনের পদ্ধতি, উচ্চকক্ষে সদস্য মনোনয়ন বা নির্বাচনের ধরন, সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনব্যবস্থা (PR), সংরক্ষিত নারী আসনের সংখ্যা ও সরাসরি নির্বাচনের প্রক্রিয়া, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদকাল সীমা, সংবিধান সংশোধনের রূপরেখা-এসব বিষয়েও মতপার্থক্য রয়েছে।
তবে আলোচনায় ইতিবাচক অগ্রগতিও হয়েছে। ইতোমধ্যে ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন, সংসদীয় কমিটির শক্তিশালীকরণ, প্রধান বিচারপতির নিয়োগ প্রক্রিয়া, রাষ্ট্রপতির ক্ষমা আইন, নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ, বিভাগীয় হাইকোর্ট বেঞ্চ স্থাপন এবং উপজেলা পর্যায়ে আদালত স্থাপনের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো ঐকমত্যে পৌঁছেছে।
কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ বলেছেন, সংস্কারে ব্যর্থতা হলে তা আমাদের সম্মিলিত ব্যর্থতা হবে। রাজনৈতিক দলগুলোকে কিছু ছাড় দিয়ে হলেও যৌক্তিক জায়গায় আসা জরুরি।
বিএনপি বলছে, সব প্রস্তাবে একমত হতে হবে এমন কোনো শর্ত গ্রহণযোগ্য নয়। সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, যেসব প্রস্তাবে ঐকমত্য সম্ভব, সেগুলো নিয়ে জাতীয় সনদ তৈরি হোক। জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি, ১২ দলীয় জোট-তারা কেউ কেউ আশাবাদী হলেও কিছু দল একে অপরকে প্রক্রিয়া ব্যাহত করার অভিযোগ করছে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান মনে করেন, সরকার সব দলকে সমান গুরুত্ব দিয়ে ভুল করছে। “মূলধারার দলগুলোর মতামতকে প্রাধান্য দিতে হবে। দেরি হওয়ার কারণে ঐক্য তৈরি হচ্ছে না। সরকারকে দ্রুত রাজনৈতিক দলগুলোকে আস্থায় আনতে হবে।
ঐকমত্য না হলে কিছু প্রস্তাবের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়ভার কমিশনের ওপর বর্তাতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আগামী সপ্তাহে দ্বিকক্ষ সংসদ ও তত্ত্বাবধায়ক কাঠামো নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত আসতে পারে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্য না এলে ‘জুলাই সনদ’ বাস্তবায়নও অনিশ্চিত হয়ে উঠবে।