জকসু নির্বাচন আটকে আছে কোন আইনি ফাঁকে?

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা কোনো এক শিক্ষার্থীর চোখে হয়তো এখনও স্বপ্ন—একটি গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। ২০০৫ সালে প্রতিষ্ঠিত এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আজ অবধি একটি কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জকসু) গঠিত হয়নি। নানা অজুহাত, প্রশাসনিক জটিলতা ও রাজনৈতিক গড়িমসির বেড়াজালে আটকে আছে এই স্বপ্নের বাস্তবায়ন। নীতিমালা তৈরি, কমিটি গঠন, মতামত আহ্বান—সবই চলছে, কিন্তু অগ্রগতি শূন্যের ঘরে।
আইনে নেই, তাই বাস্তবায়নে দেরি
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০০৫-এ কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (জকসু) কোনো ধারা বা বিধান অন্তর্ভুক্ত না থাকায় প্রশাসন সরাসরি নির্বাচন আয়োজনের পথে এগোতে পারছে না। ফলে প্রশাসনের পক্ষ থেকে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করে সেটিকে বিশ্ববিদ্যালয় আইনের অংশ হিসেবে যুক্ত করার লক্ষ্যে মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।
এই লক্ষ্যে গত ৭ মে একটি বিশেষ সিন্ডিকেট সভায় নীতিমালাটি উপস্থাপন করা হলে, শিক্ষার্থীদের মতামত অন্তর্ভুক্ত করার পরামর্শ দেন সিন্ডিকেট সদস্যরা। এরপর প্রশাসনের পক্ষ থেকে ১০ কার্যদিবসের মধ্যে শিক্ষার্থীদের মতামত নিয়ে নীতিমালা চূড়ান্ত করার সিদ্ধান্তে একটি কমিটি গঠন করা হয়।
কমিটি আছে, কাজ নেই
তবে নীতিমালা সংশোধনের জন্য গঠিত কমিটির তিন মাস পার হলেও অগ্রগতি নেই বললেই চলে। শিক্ষার্থীদের মতামত সংগ্রহ এবং বিশ্লেষণের কাজ থেমে আছে প্রায় অনড়ভাবে। ১০ কার্যদিবসের মধ্যে মতামত নেওয়ার কথা থাকলেও বাস্তবে তিন মাসে মাত্র একটি মিটিংয়েই সীমাবদ্ধ থেকেছে কমিটির কার্যক্রম।
কমিটির সদস্য সচিব ও বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন কর্মকর্তা অ্যাডভোকেট রঞ্জন কুমার দাস জানান, “১৮ জন শিক্ষার্থী মতামত দিয়েছেন। আমরা সেগুলো টেবিল আকারে সাজিয়ে এ সপ্তাহেই জমা দেব। তারপর এটি সিন্ডিকেটে যাবে এবং মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে।”
তবে শিক্ষার্থীরা বলছেন, এসব ‘কথার খেলাপ’ নতুন নয়। একের পর এক সময়ক্ষেপণের মাধ্যমে জকসু নির্বাচনের বিষয়টিকে ধোঁয়াশায় রেখে দেওয়া হচ্ছে।
‘অনুবাদ’ ও প্রশাসনিক গড়িমসি
অভিযোগ রয়েছে, এর আগেও জকসু নিয়ে ছাত্র প্রতিনিধিদের তৈরি একটি নীতিমালা প্রশাসনের কাছে হস্তান্তর করা হয়, যা বাংলায় অনুবাদের অজুহাতে দুই মাসের বেশি সময় আটকে রাখেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. সাবিনা শরমিন। এতে করে জকসু নীতিমালা প্রণয়নে আরও ধীরগতি তৈরি হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ড. শেখ মো. গিয়াস উদ্দিন বলেন, “ওয়েবসাইটে শিক্ষার্থীদের মতামত চাওয়া হয়েছিল। যেসব মতামত এসেছে তা এলোমেলো। সেগুলোকে গুছিয়ে আবার আলোচনা হবে।”
আইন সংশোধনে নেই সুযোগ, তবুও চেষ্টা
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. রেজাউল করিম বলেন, “যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হচ্ছে, তাদের আইনে তা সংযুক্ত আছে। আমাদের আইনে নেই বলেই জটিলতা তৈরি হয়েছে। দেশে সংসদ কার্যকর না থাকায় আইন সংশোধনের সুযোগও নেই। তবুও আমরা একটি নীতিমালা বিশেষ সিন্ডিকেটে পাস করেছি। এখন শিক্ষার্থীদের মতামত যুক্ত করে সেটি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে বিধি হিসেবে অনুমোদনের জন্য।”
এ বিষয়ে কমিটির আহ্বায়ক ও ইউজিসি সদস্য অধ্যাপক তানজীমউদ্দিন খানের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।
জকসু নিয়ে ছাত্র সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে বারবার দাবি উঠলেও তা আমলে নিচ্ছে না প্রশাসন—এমন অভিযোগও রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের আহ্বায়ক মেহেদী হাসান হিমেল বলেন, “আমরা জকসু নির্বাচনের পক্ষে। তবে আগে যারা আন্দোলনে অংশ নেওয়ায় নির্যাতনের শিকার হয়েছে, তাদের বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে। তারপর ফ্যাসিবাদমুক্ত ক্যাম্পাস গড়ে তুলে জকসু নির্বাচন দিতে হবে।”
ছাত্রশিবিরের সভাপতি রিয়াজুল ইসলাম বলেন, “গত ছয় মাস ধরে শুনছি নীতিমালা প্রস্তুত। অথচ বাস্তবায়ন হয়নি। ১০ আগস্টের মধ্যে নীতিমালা পাস ও সেপ্টেম্বরের মধ্যে তফসিল ঘোষণা না হলে আমরা কর্মসূচি দিতে বাধ্য হবো।”
ছাত্রফ্রন্টের সভাপতি ইভান তাহসীভ বলেন, “সব ছাত্রসংগঠনের মতামতের ভিত্তিতে একটি গ্রহণযোগ্য নীতিমালা চূড়ান্ত করা দরকার। প্রশাসনের একতরফা সিদ্ধান্ত গণতান্ত্রিক নয়।”
বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র অধিকার পরিষদের সভাপতি একেএম রাকিব বলেন, “শিক্ষার্থীদের স্বার্থ যারা বোঝেন, তারা হচ্ছেন নির্বাচিত প্রতিনিধি। তাই অবিলম্বে জকসু নির্বাচন আয়োজনের দাবি জানাচ্ছি।”